বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিনের মৃত্যু এখনো রহস্যে ঘেরা!
চলতি বছরের ৭ নভেম্বর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র ফারদিন নূর পরশের লাশ উদ্ধার করে নৌ পুলিশ। লাশ ময়নাতদন্তের পর চিকিৎসক দাবি করেন, তিনি হত্যার শিকার হয়েছেন।
পরিবার এবং তার সহপাঠীরা দ্রুত অপরাধীদের গ্রেপ্তারের ও বিচারের দাবি জানান। পরবর্তীকালে এই ঘটনা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভিন্ন আলোচনা সমালোচনার জন্ম হয়।
এরপর গত ১৪ ডিসেম্বর পুলিশ জানায়, ফারদিন নূর পরশ নিজেই আত্মহত্যা করেছেন। অন্যদিকে, একই দিনে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাবের) দাবি করে আত্মহত্যা নয়, ফারদিন নূর পরশ স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করেছেন।
অবশ্য র্যাব-পুলিশের তদন্ত প্রকাশের পর পরিবারের পক্ষ থেকে ফারদিনের বাবা কাজী নূর উদ্দিন রানা বলেন, আমার ছেলে কেন আত্মহত্যা করবে? পুলিশ-র্যাবের তথ্য আমাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না ।
এদিকে ফারদিনের মৃত্যু প্রায় দুই মাস পার হলেও মৃত্যুরহস্য নাটকীয় মোড় নিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, ফারদিনকে খুন করা হয়নি, ফারদিন নিজেই আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু এর আগে এই হত্যার তদন্ত শুরুর দিকে সরকারের বিভিন্ন বাহিনী বলেছে, ফারদিনকে হত্যা করা হয়েছে, আমরা বেশ কিছু তথ্য পেয়েছি।
এই ঘটনায় প্রথমে তদন্তকারী সংস্থা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মাদক কিনতে গিয়ে মাদক গ্যাংয়ের হাতে খুন হন ফারদিন। আবার কখনো বলা হয়েছে, চনপাড়া বস্তিতে খুন করা হয়েছে ফারদিনকে। এমনকি ফারদিনের বান্ধবীকে বিনা দোষে জেলেও যেতে হয়।
অন্যদিকে, পুলিশের তথ্যের পর একই দাবি করে র্যাব। তাদের পক্ষ থেকে গত ১৫ নভেম্বর বলা হয়, ফারদিন হত্যায় জড়িত চনপাড়া বস্তির মাদক গ্যাং রায়হান গ্রুপ। হত্যায় জড়িত থাকা ১০-১২ জনকে শনাক্ত করার কথাও বলা হয়।
ফারদিনকে নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে নানা ধরেনর সংবাদ প্রকাশিত হয়। ওই সব সংবাদে বলা হয়, মাদক কিনতে গিয়েই চনপাড়া বস্তিতে খুন হয়েছেন ফারদিন। খুন করার পর সাদা প্রাইভেটকারে মরদেহ বের করা হয় বস্তি থেকে। পরে ফেলে দেওয়া হয় শীতলক্ষ্যা নদীতে।
গণমাধ্যমকে সূত্র দিয়ে সংবাদ প্রকাশ হলেও ফারদিন হত্যা মামলা তদন্তের দায়িত্বে থাকা ডিবি পুলিশ এবং অন্যান্য ছায়া তদন্তকারী সংস্থাগুলোও বিভিন্ন বিষয় মাথায় রেখেই প্রাথমিক তদন্ত করতে থাকেন। তদন্তের স্বার্থে একাধিক ব্যক্তিকে তারা আটক করে জিজ্ঞাসাবাদও করে। কিন্তু তাকে খুন করা হয়েছে এমন তথ্য-প্রমাণ পায়নি কোনো সংস্থাই। তারা ভিন্ন এক বার্তা দেন কিন্তু সেটা অনেকেই মানতে নারাজ।
ফারদিন হত্যার ঘটনায় বাবার করা মামলায় একমাত্র আসামি তার বান্ধবী বুশরা জেলে আছেন এক মাসেরও বেশি সময় ধরে। অথচ ডিবি বলছে, ফারদিনের মৃত্যুর ঘটনায় তার সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। অনেকেই বলছেন, তাহলে বুশরা কেন জেলে থাকবে? তাকে জামিন দেওয়া হোক।
অন্যদিকে, ডিবি পুলিশ ও র্যাবের সঙ্গে এই হত্যার বিষয় নিয়ে ফারদিনের সহপাঠীরা বলছেন, সবকিছু আমরা দেখেছি। কিছু বিষয় আরও পরিষ্কার হওয়া দরকার। তবে তারা কেউ গণ্যমাধ্যমে তাদের নাম প্রকাশ করেনি।
গত ৭ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টার দিকে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ফারদিন নূর পরশের মরদেহ উদ্ধার করে নৌ-পুলিশ। এ ঘটনায় বান্ধবীসহ অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ‘হত্যা করে লাশ গুম’ করার অভিযোগে রামপুরা থানায় মামলা হয়। ফারদিনের বাবা নূর উদ্দিন রানা বাদী হয়ে ওই মামলা করেন। মামলার পর গত ১০ নভেম্বর ফারদিন নূর পরশকে হত্যা করে মরদেহ গুম করার অভিযোগে রাজধানীর রামপুরা এলাকার একটি বাসা থেকে তার বান্ধবীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এ বিষয়ে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) সদর দপ্তরের মুখপাত্র (মিডিয়া পরিচালক) কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, বুয়েটছাত্র ফারদিন নূর পরশ স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করেছেন।
খন্দকার আল মঈন বলেন, ফারদিনকে কেউ হত্যা করেনি। তিনি নিজের ইচ্ছায় নদীতে ঝাঁপ দিয়ে মারা গেছেন। আমরা ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ উদ্ধার করেছি সেগুলো বিশ্লেষণ করে কাজ করা হচ্ছে এবং এ ঘটনার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে আমরা বিভিন্ন আলামত দিয়েছি। তিনি ফাইনাল তদন্ত আদালতে যখন দেবেন তখন এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত হয়তো জানা যাবে।
তিনি বলেন, আমরা প্রাথমিক তদন্তে ফারদিনের মৃত্যু সংক্রান্ত যেসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এবং অগ্রগতি পেয়েছি সেগুলোই গণমাধ্যমকে বলেছি। তবে তিনি খুন হয়নি, স্বেচ্ছায় নদীতে ঝাঁপ দিয়েছেন।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান ডিআইজি মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ফারদিন নূর পরশ আত্মহত্যা করেছেন। ভিডিওতে পরিষ্কার দেখা গেছে। তা ছাড়া, তিনি বেশ কিছু বই পড়তেন। আমরা সেটাও জানতে পেরেছি।
তিনি বলেন, ফারদিন যেসব বই পড়ত সেই বইয়ে মৃত্যু নিয়ে বিভিন্ন জিনিস লেখা ছিল। তা ছাড়া, সে তার বন্ধুদের বলতো একটি মানুষ ৩০ বছরের বেশি বাচঁতে চায় না। এমন সব কথা বলতো সে বন্ধুদের সঙ্গে। তিনি বলেন, সব কিছু বিশ্লেষণ করে আমরা বুঝতে পেরেছি সে আত্মহত্যা করেছে।
ফারদিন নূর পরশের বাবা বলেন, আমার ছেলে কেন আত্মহত্যা করবে। এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। ফারদিনসহ আমার কোনো ছেলেই আত্মহত্যার পথ বেঁছে নেবে না। এটা অন্য কোনো বিষয়।
ফারদিনের বাবা কাজী নূর উদ্দিন রানা বলেছেন, ‘ফারদিনের আত্মহত্যার বিষয়ে তদন্তকারী সংস্থা যে তথ্যপ্রমাণ দেখিয়েছে সেটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। তদন্তকারী সংস্থা আমাদের পরিবারের দেওয়া কোনো তথ্য প্রমাণ আমলে নেয়নি।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমার স্ত্রীকে বলেছি ফারদিন যে পথে মারা গেছে সেই পথেই আমাদের মৃত্যু হবে। তারপরও আমরা ছেলে হত্যার বিচার চাই।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক (অপরাধ বিশেষজ্ঞ) তৌহিদুল হক বলেন, ফারদিন আত্মহত্যা করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের এমন তথ্য দেশের মানুষ মেনে নিতে পারছে না। তার কারণ হলো তাদের তদন্তের অগ্রগতির সঙ্গে আত্মহত্যার মিল নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। এজন্য এটাকে ফারদিনের পরিবার বা তার সহপাঠীরা মেনে নিতে পারছে না।
তিনি বলেন, দেখা গেছে প্রশাসন বিভিন্ন সময় গণ্যমাধ্যমে এই হত্যা নিয়ে বিভিন্ন তথ্য দিয়েছে তারা বলেছেন তিনি খুন হয়েছেন। এখন শেষের দিকে এসে বলা হচ্ছে ফারদিন আত্মহত্যা করেছে।
তিনি বলেন, এখন ফারদিন হত্যা নিয়ে জনমতে প্রশ্ন হলো ফারদিনের আত্মহত্যা করতে এত জায়গা রেখে কেন তিনি নদীতে যাবেন! তা ছাড়া, এই মৃত্যুরহস্য কোন দিকে যাচ্ছে? বা এর তদন্তের মোড় নাটকীয় মোড় নিচ্ছে কি না?
এদিকে, ১৭ ডিসেম্বর পুলিশ-র্যাবের তদন্তে বুয়েট শিক্ষার্থীরা সন্তুষ্ট প্রকাশ করে বলেছেন-ফারদিন হত্যার ঘটনায় আপাতত আমরা কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করছি না।
উল্লেখ্য, এই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ পিছিয়ে আগামী ১৫ জানুয়ারি ধার্য করেছেন আদালত। গত ১২ ডিসেম্বর মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ধার্য ছিল। কিন্তু এদিন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের খিলগাঁও জোনাল টিমের পুলিশ পরিদর্শক মজিবুর রহমান প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেননি। এজন্য ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শান্ত ইসলাম মল্লিক প্রতিবেদন দাখিলের এ তারিখ ঠিক করেন।
নিখোঁজের তিন দিন পর নারায়নগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে গত ৭ নভেম্বর রাতে ফারদিনের লাশ উদ্ধার করে নৌ পুলিশ। পরে ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালে নেওয়া হয়। তার শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে বলে জানান চিকিৎসকরা। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যরা এই ঘটনার রহস্য উন্মোচন করতে কাজ করেন। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা দেশ ব্যাপী আলোচিত হয়। তবে এটি নিয়ে এখনো নানামুখি আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। কেউ মানতে পারছেন না ফারদিন আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছন।
কেএম/এমএমএ/