১০ মিনিটেই পুলিশের নিয়ন্ত্রণে নয়াপল্টন
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ না করাকে কেন্দ্র করে নয়াপল্টনে বিএনপি এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ১০ মিনিটেই পুরো এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
রাজধানীর নয়াপল্টনে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির কর্মীদের দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনায় রণক্ষেত্রে পরিনত হয়েছে পুরো এলাকা। এ ঘটনায় একজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৩ শতাধিক। তবে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে পুলিশের অভিযানে ১০ মিনিটের মধ্যে ফাঁকা হয়ে যায়। পরে বিএনপি কর্মীরা বিভিন্ন ওলি গলি থেকে পুলিশের ওপর ককটেল ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করলে পুলিশ টিয়ারশেল ও কাঁদানি গ্যাস নিক্ষেপ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
নয়াপল্টনের নিয়ন্ত্রন নেওয়ার পর পুরো এলাকায় কয়েকহাজার দাঙ্গা দমন পুলিশ এবং সোয়াট মোতায়েন রয়েছে। এদিকে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, শহিদ উদ্দীন চৌধুরী অ্যানি, শিমুল বিশ্বাসসহ কয়েকজনকে আটক করেছে পুলিশ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আগামী ১০ ডিসেম্বর বিএনপির সমাবেশের স্থান নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হলেও বিএনপি তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সমাবেশের ব্যাপারে অনড় ছিলো। এমন অবস্থায় বুধবার (৭ ডিসেম্বর) সকাল থেকেই বিনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে নেতাকর্মীরা জড়ো হন। সকাল ১১ টার দিকে পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপ-কমিশনার হায়াতুল ইসলাম খান নয়াপল্টনের সমাবেশের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার আহ্বান জানান। পাশাপাশি নয়াপল্টনের সামনের সড়কটি খুলে দেওয়ার জন্য বলেন। কিন্তু বিএনপির নেতাকর্মীরা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের রাস্তা বন্ধ করে সমাবেশ করতে থাকে। এমন অবস্থায় দুপুর ২ টার পর অতিরিক্ত পুলিশ এসে সতর্কবস্থা গ্রহন করে। এক পর্যায়ে বিএনপি কর্মীরা পুলিশকে উদ্দেশ্য করে নানা উস্কানিমূলক শ্লোগান এবং এক পর্যায়ে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। এমন অবস্থায় পুলিশ অ্যাকশনে যায়। ক্রমাগত টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। পাশাপাশি এপিসি থেকেও নিক্ষেপ করা হয় রাবার বুলেট।
প্রায় ১০ মিনিট এভাবে চলার পর বিএনপি কর্মীরা তাদের কার্যালয়ের সামনে থেকে সরে গিয়ে বিভিন্ন ওলিগলিতে ঢুকে পড়ে। এ সময় পুলিশ, সোয়াট ও ডিবির সদস্যরা পুরো এলাকার নিয়ন্ত্রন নিয়ে নেয়।
বিএনপি কর্মীরা ওলিগলি থেকেই ককটেল ও বৃষ্টির মত ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। পুলিশও গলির ভেতরে ঢুকে রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল চার্জ করে। আর এভাবেই চলতে থাকে।
সংঘর্ষে নিহত ১ আহত ৩ শতাধিক
খালেদা জিয়ার প্রেস উইং সদস্য শায়রুল কবির খান বলেন, পুলিশের সঙ্গে বিএনপি কর্মীদের সংঘর্ষে একজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে এবং তিন শতাধিক আহত হয়েছে। আমরা এটির ক্ষতিপূরণ ও ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।
নিহতের নাম মকবুল হোসেন মুকুল (৩৫)। তবে সে বিএনপি কর্মী বা নেতা কিনা সেটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এছাড়াও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আহতরা হলেন, বোরহান উদ্দিন কলেজ ছাত্রদলের কর্মী আনোয়ার ইকবাল, পল্টন থানা যুবদলের কর্মী মো. খোকন, মো. মনির হোসেন, মো. রাশেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি জসীমউদ্দীন হলের ছাত্রদলের নেতা মো. ইয়াসির আরাফাত, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রদলের নেতা মো. সুমন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের নেতা মো. জহির হাসান, রূপনগর থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা মো. শামীম, কদমতলী থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা মো. হানিফ, মো. হৃদয়, মো. মকবুল হোসেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মো. ফারহান আরিফ, শাহবাগ থানা যুবদল নেতা মো. নূরনবী, মনির, শাহ আলী থানা যুবদলের নেতা মো. সুলতান আহমেদ, শেরেবাংলা নগর যুবদলের নেতা মো. আমিনুল ইসলাম, গুলশান থানা ছাত্রদলের নেতা আশরাফুল ইসলাম, ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রদলের বিপ্লব হাওলাদার, মো. আসাদুজ্জামান, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের নেতা মো. মেহেদী হাসান নয়ন। এছাড়াও আরো অনেকে বিভিন্ন বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ভর্তি হয়েছেন।
ডিএমপির মতিঝিল জোনের ডিসি হায়াতুল ইসলাম খান বলেন, এখনও বিএনপির সমাবেশের স্থান নির্ধারণ করা হয়নি। কিন্তু তারা (বিএনপি কর্মীরা) রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছেন। বারবার অনুরোধ করার পরও তারা কথা শোনেনি। পুলিশ তাদের তুলে দিতে গেলে সংঘর্ষ বেঁধে যায়।
তিনি বলেন, গত দু’দিন ধরে তাদের বলা হচ্ছে রাস্তা ছেড়ে দিতে। যেহেতু তাদের এখানে সমাবেশের অনুমতি নাই সেহেতু আমরা ধৈর্য্য সহকারে বার বার বলেছি কিন্তু তারা শোনেনি।
আটকের আগে বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য সচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী গ্রেপ্তারের আগে বলেছেন, আমরা একটি শান্তিপূর্ণ সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছিলাম। পুলিশ যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, আমরা তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। সমাবেশের স্থান নিয়ে প্রশাসন ও আমাদের সঙ্গে আলোচনা চলছিল। এরই মধ্যে এই ধরনের ঘটনা খুবই দুঃখজনক।
পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারের আগে বিএনপি নেতা আমানুল্লাহ আমান বলেছেন, দেশের মানুষের কাছে আজ প্রমাণিত হয়েছে। সরকার পুলিশ দিয়ে ক্ষমতা দখল করে রাখতে চাই। কোন হামলা বিএনপিকে আটকে রাখতে পারবেনা সমাবেশ আমাদের সফল হবে।
এদিকে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব সরকার বলেন, জনগণের নিরাপত্তা দেওয়াই আমাদের প্রথম দায়িত্ব । যত ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার তা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ গ্রহণ করবে।
যুগ্ম পুলিশ কমিশনার মেহেদী হাসান বলেন, বিএনপির নেতাকর্মীরা তাদের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান করে পুরো এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। এমতাবস্থায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যেন অবনতি না ঘটতে পারে তার জন্য ডিএমপি কর্তৃপক্ষের যা যা করণীয় করেছে। এখন পর্যন্ত সব কিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে।
এদিকে সরেজমিনে সন্ধ্যা ৭ টার দিকে দেখা যায় পুলিশ কাকরাইল মোড় থেকে নাইট্যাঙ্গেল মোড় হয়ে বিজয়নগর সড়ক, পল্টন থানার মোড় থেকে শুরু করে দৈনিক বাংলা সড়ক পুরো এলাকার নিয়ন্ত্রন নিয়ে অবস্থান করছে। পুলিশের সাঁজোয়া যান এপিসি, জলকামান প্রস্তুত রাখা হয়েছে। দাঙ্গা দমন পুলিশের পাশাপাশি সোয়াট ও কাউন্টার টেরোরিজমের সদস্যরাও মোতায়েন রয়েছে।
অন্যদিকে পুলিশ নয়াপল্টনের নিয়ন্ত্রন নেওয়ার পর তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ভেতরে গ্রেপ্তার অভিযান পরিচালনা করে। সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত যুগ্মসচিব রুহুল কবির রিজভী, শিমুল বিশ্বাস, শহিদ উদ্দীন চৌধুরী অ্যানিসহ অন্তত অর্ধশত গ্রেপ্তার হয়েছে।
জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে পুলিশ আমাদের নেতাকর্মীদের উপর হামলা করেছে। এই ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। আগামীকাল সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে বিস্তারিত সেখানে আমরা তুলে ধরবো।
ঘটনার পর বিএনপি মহাসচিব নয়াপল্টন পার্টি অফিসের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন এ সময় জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকার পুরাতন খেলায় লিপ্ত হয়েছে। এটা তাদের পুরাতন গেম। তিনি বলেন সমাবেশ হবে, কোনভাবেই সমাবেশ থামাতে পারবে না এই সরকার। হামলা মামলা করে কোন আতঙ্ক তৈরি করে আমাদের সমাবেশ বন্ধ করা যাবে না।
জানতে চাইলে খালেদা জিয়ার প্রেস উইং সদস্য শায়রুল কবির খান বলেন, তিন শতাধিক আহত হয়েছে। আমরা আহতদের ক্ষতিপূরণের দাবি করছি। এই ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।
জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেছেন, আমরা আগে থেকেই বলেছি নয়াপল্টনে সমাবেশ করে জনদুর্ভোগ এবং জনমতে আতঙ্ক তৈরি করতে দেওয়া হবে না। তিনি বলেন, নয়াপল্টনে অবস্থান নিলে বিএনপি নেতাকর্মীদের পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয় সরে যেতে কিন্তু তারা উল্টা পুলিশের উপর আক্রমণ করে এরপরে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে তবে এই ঘটনার তদন্ত চলছে।
কেএম/এএস