শৌচাগার সংকটে ট্রাফিক পুলিশের নারী সদস্যরা ভোগান্তিতে
নগরবাসীকে স্বস্তি দিতে সড়কে শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে দিনে-রাতে শ্রম দিচ্ছেন ট্রাফিক পুলিশের নারী সদস্যরা। রোদ-বৃষ্টি, ঝড়-বাদল উপেক্ষা করে তারা ট্রাফিক পুলিশের পুরুষ সদস্যদের সঙ্গে সমানতালে কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু রাস্তায় শৃঙ্খলা ফেরানোর কাজে নিয়োজিত ট্রাফিক পুলিশের এ সব নারীর সদস্যদের সমস্যার শেষ নেই।
সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে তাদের জন্য আপদকালীন কোনো শৌচাগার নেই। নেই কোনো বিশ্রামাগার। ট্রাফিক পুলিশের নারী সদস্যদের অভিযোগ, আশেপাশের মার্কেটে শৌচাগার ব্যবহার করতে গেলে পড়তে হয় বিভিন্ন সমস্যায়।
ট্রাফিক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকার সড়কের শৃঙ্খলা রক্ষায় ট্রাফিক পুলিশের প্রায় পাঁচ হাজার সদস্য কাজ করছেন। এরমধ্যে নারী সদস্য প্রায় তিন শতাধিক।
ট্রাফিক পুলিশের একাধিক নারী সদস্য জানান, নিজের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই তারা নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। কিন্তু সংকটের সমাধান হচ্ছে না। সমস্যা সমাধানে ট্রাফিকের নারী সদস্যদের পক্ষ থেকে কর্তৃপক্ষকে বিশেষভাবে অনুরোধও করা হয়েছে।
ট্রাফিক সদর দপ্তর বলছে, নগরীর সিংহভাগ এলাকায় কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশের জন্য নেই তেমন কোনো শৌচাগার সুবিধা। হঠাৎ কেউ অসুস্থ হলে বা ক্লান্তি এলে একটু বিশ্রামেরও সুবিধা নেই।
চিকিৎসকরা বলছেন, টয়লেট চেপে রাখা একদম ভালো না। নিয়মিত এটি করলে অনেক জটিল রোগে আক্রান্ত হতে হয়। বিশেষ করে ইউরিন ইনফেকশন হতে পারে। যার কারণে পেটের ভেতরে বড় ধরনের রোগে আক্রান্ত হতে পারে, এমনকি পেটের ভেতরের টয়লেটের রাস্তায় নাড়ি ছিড়ে যেতে পারে এবং পায়ু পথ দিয়ে রক্ত যেতে পারে।
রাজধানীতে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের একাধিক নারী বলছেন, ট্রাফিক বক্সে কোনো শৌচাগার না থাকায় আশেপাশের মার্কেট, হাসপাতাল বা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হতে হয়। তবে সন্ধ্যার পর এ সব অফিস বা মার্কেট বন্ধ হয়ে গেলে নানা সমস্যায় পড়তে হয়। তাদের অভিযোগ, রাতে বা সন্ধ্যার পরে আশেপাশের মার্কেটে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেলে অনেক মানুষ আড় চোখে তাকিয়ে থাকে। কিছু কিছু মানুষের কথা বার্তা ও বডি মুভমেন্ট অনেক বাজে থাকে, মনে হয় মলেস্টেশনের শিকার হচ্ছি।
তেজগাঁও বিভাগে কর্মরত ট্রাফিক পুলিশের নারী সদস্য সার্জেন্ট শিল্পী আক্তার ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘অনেক সময় ছুটির দিনে আশেপাশের শৌচাগারগুলো বন্ধ থাকে। তখন বেশ সমস্যায় পড়তে হয়। চাকরির শুরু থেকেই এই সমস্যায় ভুগছি এর সমাধান হওয়া উচিত।’
ধানমন্ডিতে কর্মরত ট্রাফিক সদস্য শুকরা বসু ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আমাদের নিজস্ব শৌচাগার না থাকায় নিয়মিত ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। এই ভোগান্তি ট্রাফিক পুলিশের পুরুষ সদস্যদের চেয়ে নারীদের বেশি। তিনি বলেন, আমরা সারাদিন রাস্তায় কাজ করি। অনেক সময় পাবলিক টয়লেট ব্যবহার করতে হয়। সেখানের পরিবেশ অনেক খারাপ থাকে। অনেক সময় বাজে অভিজ্ঞতায় পড়তে হয়। আমাদের নিজেদের যদি একটা শৌচাগার বা ওয়াশরুম থাকত তাহলে আমরা এ সব বাজে অভিজ্ঞতা থেকে রেহাই পেতাম।
মিরপুরের কালশী এলাকায় কর্মরত এক নারী সদস্য ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আমরা শৌচাগার সমস্যার সমাধান চাই। এটি দ্রুত হওয়া উচিত এবং এটা ট্রাফিকের নারী সদস্যদের দীর্ঘদিনের দাবি।
রাসেলস্কয়ারে ডিউটিরত ট্রাফিক সার্জেট নাদিয়া ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আমি বাস কাউন্টারে গিয়ে শৌচাগার ব্যবহার করি। সেখানের পরিবেশ মোটেও ভালো না। অনেক সময় কাউন্টার মাস্টার, চালক এবং কন্ডাক্টর ও হেলপাররা আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন।
তিনি বলেন, আমাদের ওয়াশরুম না থাকায় পানি এবং খাবার কম খেয়ে থাকি।
রমনা এলাকায় ট্রাফিক পুলিশের একজন সার্জেন্ট ও একজন কনস্টেবল নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সর্বক্ষেত্রে নারীরা এগিয়ে আছে এই কথাটা সবাই বলে কিন্তু নারীদের এই এগিয়ে যাওয়াটা অনেকে ভালো চোখে দেখে না। তাদের দাবি, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে আশেপাশের মার্কেট, হাসপাতাল বা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হতে হয়। এটা বেশ অস্বস্তিকর।
রামপুরা মোড়ে ডিউটিরত ট্রাফিক সার্জেন্ট সাবিনা আক্তার ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আমাদের শৌচাগার নিয়ে অনেক কিছু হচ্ছে, কিন্তু এর সমাধান হচ্ছে না। অনেক বার আমরা এ বিষয়ে উপরের স্যারদের অভিযোগ দিয়েছি। এত কিছুর পরও এ বিষয়ে আমরা কোনো উপকার পাচ্ছি না। শৌচাগার না থাকায় অনেক সময় আমাদের নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয়।
ঢাকাপ্রকাশ-কে প্রায় একই কথা বলেন বাড্ডা জোনে কর্মরত মোছা. ইয়াসমিন। তিনি বলেন, আমার সহকর্মীসহ অনেক নারী ট্রাফিকের অভিযোগ বাইরে শৌচাগার ব্যবহার করতে গেলে নারী হিসেবে অনেকটা যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়। তিনি বলেন, বাইরের টয়লেটে গেলে অনেক ধরনের সমস্যা ফেস করতে হয়। তা ছাড়া এ সব জায়গায় গেলে পুলিশের পোশাক পরা অবস্থায় মেয়ে দেখলে অনেকে আড় চোখে তাকিয়ে থাকে।
জানতে চাইলে ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক গৌরব রঞ্জন সরকার ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, বেশি সময় ধরে টয়লেট বা প্রস্রাব ধরে রাখলে ইউরিন ইনফেকশন হয়। এ কারণে বমি, জ্বর, ব্যাথা, জ্বালা-যন্ত্রণাসহ অন্যান্য রোগ দেখা দেয়।
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) মঞ্জুরুল ইসলামে ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ট্রাফিক বক্স স্থাপনকারী সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে পুলিশের পক্ষ থেকে শৌচাগার বা ওয়াশরুমের বিষয়টি সমাধানের জন্য বিশেষ অনুরোধ করা হয়েছে। কিছু কিছু স্থানে এর সমাধানও হচ্ছে। আমরা এই সংকট সমাধানের চেষ্টা করছি।
ট্রাফিক পুলিশের প্রধান কমিশনার মনিবুর রহমান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, কিছু কিছু জায়গায় শৌচাগার সংকট সমাধান হচ্ছে এবং এ বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি। তা ছাড়া সিটি করপোরেশন আমাদের বলেছে অনেক জায়গায় শৌচাগার তৈরি করতে অসুবিধা হচ্ছে তবে ইতোমধ্যে বিষয়টি সমাধানের জন্য আমরা চেষ্টা করছি।
জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ট্রাফিক পুলিশের শৌচাগারের সংকটটি দীর্ঘদিনের। আমরা এই সংকট সমাধানের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। এটি সমাধান হওয়া জরুরি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আশেপাশের মার্কেটে শৌচাগার ব্যবহার করতে গেলে একটু সমস্যায় পড়তে হয়। এই সমস্যাটি সমাধানের জন্য আমরা নতুন করে কাজ করছি। আশা করি এই সংকট সমাধান হবে।
এনএইচবি/আরএ/