রাজধানীতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবার, ঝুঁকিতে জনস্বাস্থ্য
রাজধানী ঢাকার অলিগলিতে যত্রতত্র গড়ে উঠেছে হোটেল-রেস্তোরাঁ। কিন্তু কোথাও খাবারের পরিবেশ নেই। মানসম্পন্ন ও স্বাস্থ্যকর খাবার পাওয়াও মুশকিল। বেশিরভাগ হোটেল-রেস্টুরেন্টে খাবার যেমন তৈরি হচ্ছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে, তেমনি রাখাও হচ্ছে উম্মুক্ত স্থানে। ধুলাবালি, নোংরা পরিবেশ, ময়লা–আবর্জনা আর মশা-মাছি ও পোকা তো আছেই। অস্বাস্থ্যকর এসব খাবার খেয়ে পেটের পীড়াসহ নানারকম রোগবালাইয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন নগরবাসী।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বেশ কয়েকটি হোটেল-রেস্টুরেন্ট ঘুরে দেখা গেছে কিভাবে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবার তৈরি ও পরিবেশন হচ্ছে।
এসব হোটেলে খাবার খেতে আসা মানুষের অভিযোগ, পরিবেশ খারাপ থাকলেও তাদের সামনে উপায় নেই। রাজধানীর এসব হোটেলের বেশিরভাগ কাস্টমার বা ভোক্তাই হচ্ছে চলতি পথের মানুষ। বিভিন্ন পেশার লোকজন। গাড়ি চালক, স্বল্প বেতনের চাকরিজীবী, রিকশা চালকসহ নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেনীর।
খাবার খেতে আসা কেউ কেউ বলেছেন, পকেটে টাকা থাকলেও ভালো খাবার খাওয়ার উপায় নাই। কারণ যে হোটেলেই ঢুকবেন অবস্থা কিন্তু একই। নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। কিন্তু এগুলো দেখার কেউ নেই। না সিটি করপোরেশন, না জনস্বাস্থ্যবিভাগ কারোরই নজর নেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ৬০ কোটি মানুষ দূষিত খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়। প্রতিবছর মারা যায় প্রায় ৪ লাখ ৪২ হাজার মানুষ। এছাড়া, পাঁচ বছরের চেয়ে কম বয়সী শিশুদের ৪৩ শতাংশ অনিরাপদ খাবারজনিত রোগে আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে প্রতিবছর মারা যায় ১ লাখ ২৫ হাজার শিশু।
কারওয়ান বাজারে 'আল্লাহর দান' হোটেলে গিয়ে দেখা গেছে, প্রায় সময় এই হোটেলে ভিড় লেগে থাকে, কিন্তু ভিতর ও বাইরের পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর। এই হোটেলের খাবার থাকে বাইরের দিকে রাস্তার পাশে, ফলে খাবারের মধ্যে ধুলাবালি পড়তেই থাকে।
এই হোটেলে খেতে আসা মো. আলামিন বলেন, কারওয়ান বাাজারের কাঁচা মার্কেটের আশেপাশে তেমন কোনো ভালো হোটেল নেই। যেগুলো আছে সে গুলোতে খেতে যাওয়ার মতো আমাদের সাধ্য নেই। কিন্তু এখানে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা নাই বললেই চলে। হোটেল বয় হাত না ধুয়েই খাবার পরিবেশন করছে।
মিরপুর ৬ নম্বরের মদিনা হোটেলের খেতে যাওয়া ফয়সাল বলেন, আমাদের মতো মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য বাইরের হোটেল একেবারে নিরাপদ নয়। অনেক সময় ক্ষুধার যন্ত্রণায় বাধ্য হয়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশেই এসব হোটেলে খেতে হয়।
মহাখালী ওয়্যারলেস গেটে অবস্থিত বৈশাখী হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্টের কাস্টমার জাকির হোসেন মোল্ল্যা বলেন, এই হোটেলের শেফ ও হোটেল বয় কেউ ঠিক মত হাত পরিস্কার করে না। এসব অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খবার খেয়ে বিভিন্ন রোগে আক্রান্তও হচ্ছি। কিন্তু পেটের দায়ে খাবার তো খেতেই হয়।
মালিবাগ রেলগেটে আবুল হোটেলে খেতে যাওয়া রোজিনা বেগমের অভিযোগ, আবুল হোটেলের এতো নাম ডাক শুনলাম। কিন্তু ভিতরের পরিবেশ একেবারেই অসাস্থ্যকর। হোটেল বয় এক হাত দিয়ে বিড়ি খাচ্ছেন আবার অন্য হাত দিয়ে জিলাপী, পুড়ি বা অন্যান্য খাবার তৈরি করছেন। যা দেখে অনেক কাস্টমার চলেও যাচ্ছে আবার কেউ কেউ ওই হোটেলে বসে খাচ্ছেন।
একই অবস্থা রাজধানীর বাবু বাজার মোড়ে মিজান বিরিয়ানি হোটেল, পুরান ঢাকার শাহী হোটেল-রেস্টুরেন্ট ও মামুন বিরিয়ানি হাউজসহ এরকম হোটেল-রেঁস্তোতার।
জানতে চাইলে মিজান বিরিয়ানি হাউজের মালিক মিজান বলেন, আমি ১৫ বছর ধরে এখানে ব্যবসা করি। হোটেলে জায়গা কম হওয়ায় ভিতরের পরিবেশ অনেকটা খারাপ দেখা যায়। তিনি বলেন, মাঝে মাঝে আমরা কিছু বিরিয়ানী রাস্তার পাশে রান্না করি। আর সকালেরটা বাসা থেকে রান্না করে নিয়ে আসি।
তবে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ রয়েছে এমন অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন পুরান ঢাকার মামুন বিরিয়ানি হাউজের ম্যানেজার মো. মিজান বলেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা শিশু হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক খাদ্য ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞ পুষ্টিবিদ মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী না হলে অল্প অসুস্থতাতেও মানুষ খুব সহজে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং রোগের আক্রমণও জোরালো হয়। এক্ষেত্রে খাদ্যাভ্যাস এবং জীবন-যাপনের পদ্ধতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, টেকসই জীবন ও সুস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবারের বিকল্প নেই। অনিরাপদ খাদ্য স্বাস্থ্য ঝুঁকির অন্যতম কারণ। ডায়রিয়া থেকে শুরু করে ক্যান্সারসহ প্রায় ৩০০ শতাধিক রোগ হতে পারে। তার মূল কারণ হলো আমরা কি খাচ্ছি? যে খাবারটা আমাদের শরীরে যায় সেটা স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ কিনা দেখতে হবে। এক্ষত্রে আমাদের অতিরিক্ত সর্তক হতে হবে।
তিনি বলেন, রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণস্থানে বেশিরভাগ খাবার হোটেল বা রেস্টুরেন্টগুলোর বাইরের দৃশ্য মোটামুটি ভালো থাকলেও খাবার যেখানে তৈরি হচ্ছে সেখানকার পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর। এমনকি পঁচা-বাসি খাবারও অনেক হোটেলে বিক্রি হয়। অনেকেই এসব খাবার খেয়ে নানা ধরণের রোগে আক্রান্ত হয়।
এনএইচবি/এএস