‘দেশের জাতীয় ইতিহাস যে ধ্বংস করবে, সে জাতীয় বেইমান’
দেশের ইতিহাস যে নষ্ট করতে চাই সে জাতীয় বেইমান বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের (এনডিএফ) কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম জাহাঙ্গীর হোসাইন।
বৃহস্পতিবার (১৩ অক্টোবর) রাজধানীর বাহাদুর শাহ পার্কে ‘ফুড ভ্যান’ নামে খাবার দোকান নির্মাণের প্রতিবাদে আয়োজিত মানববন্ধনে এ কথা বলেন তিনি।
১৮৫৭ সালের ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শহীদদের স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক বাহাদুর শাহ পার্ক রক্ষায় জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (এনডিএফ) ঢাকা মহানগর কমিটি এই বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল করে। গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট ঢাকা মহানগর কমিটির সহ-সভাপতি জয়নাল আবদীনের সভাপতিত্বে এবং দপ্তর সম্পাদক আতিকুল ইসলাম টিটুর পরিচালনায় এই প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এনডিএফ’র কেন্দ্রীয় কমিটি সাধারণ সম্পাদক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম জাহাঙ্গীর হোসাইন বলেন, ‘ফুড ভ্যান’ প্রকল্প নামে পার্কের ভেতরে খাবারের দোকান তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে ডিএসসিসি। এজন্য তারা গত ৩ আগস্ট ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা দরে দরপত্র আহ্বান করে। দরপত্র পাওয়া কর্তৃপক্ষ পার্কের ভেতরে স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ শুরু করেছে। সিটি করপোরেশনের কি এতই অভাব যে পার্ক ইজারা দিয়ে তাদের টাকা নিতে হবে? সুস্থ মস্তিষ্ক এবং শারীরিকভাবে সতেজ থাকতে হলে নিয়মিত ব্যায়াম দরকার। আমরা ছোটবেলায় বিকালে মাঠে খেলতে যেতাম, সন্ধ্যায় পড়তে বসতাম। এখন আমাদের জীবন অ্যাপার্টমেন্টে বন্দী হয়ে গেছে। এখন বাচ্চারা মুক্ত অক্সিজেন নিতে পারছে না। এই এলাকার মানুষের মুক্ত বাতাস গ্রহণের জন্য হলেও পার্ক রাখতে হবে। ভিক্টোরিয়া পার্ক শুধু পার্ক নয়, এটি বাংলার ইতিহাস। এই ইতিহাস যে নষ্ট করতে চায় সে জাতীয় বেইমান। এই পার্কের আশপাশে রয়েছে অনেকগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী এখানে অবসর সময় কাটাতে পারে, সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চা করতে পারে। কিন্তু এখানে খাবারের দোকান দিলে এটির পরিবেশ সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে যাবে।
তিনি আরও বলেন, সিটি করপোরেশনের উদ্দেশ্য কী? তারা কি দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি ধ্বংস করতে চায়? একটা দেশকে পঙ্গু করতে চাইলে প্রথমে সে দেশের তরুণ প্রজন্ম এবং তার শিক্ষা সংস্কৃতি ধ্বংস করতে হয়। সিটি করপোরেশন তো তাই করছে।
এ ছাড়া বক্তব্য রাখেন সাবেক এডিশনাল অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মনসুর হাবীব, ধ্রুবতারা সাংস্কৃতিক সংসদের সভাপতি শ্যামল ভৌমিক, বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাহ আলম ভুঁইয়া, বাংলাদেশ ও এসকে গার্মেন্টস অ্যান্ড টেক্সটাইল শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ দত্ত, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট ঢাকা মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক আখতারুজ্জামান খান, বাহাদুর শাহ পার্ক সংরক্ষণ পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট ইলিয়াস হোসেন, বাহাদুর শাহ পার্ক প্রাতঃভ্রমণকারী সমিতি সভাপতি ছানাউল্লাহ হকসহ অনেক লেখক, কলামিস্ট, সুশীল সমাজ।
বক্তারা বলেন, বাহাদুর শাহ পার্ক শুধু পার্ক নয়, এটি ১৮৫৭ সালের ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর শহীদদের রক্তে রঞ্জিত এক ঐতিহাসিক স্থান। ১৮৫৭ সালে ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের দেশপ্রেমিক বীর সিপাহীদের ধরে এনে তৎকালীন আন্টাঘর ময়দান নামে পরিচিত জায়গায় জনগণকে ভয় দেখানোর জন্য নির্যাতন করে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত গাছের উপর ঝুলিয়ে রেখেছিল বর্বর ইংরেজরা। এই ঘটনার ধারাবহিকতায় ১৮৫৮ সালে রানী ভিক্টোরিয়া ভারতবর্ষের শাসনভার গ্রহণ করে। রানীর শাসনভার গ্রহণ করার ঘোষণা এই ময়দানেই (পার্ক) করা হয় এবং এই ময়দানের নামকরণ করা হয় ভিক্টোরিয়া পার্ক। পরবর্তীতে ১৯৫৭ সালে ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধের ১০০ বছর পূর্তিতে যেসব বীরদের নৃশংসভাবে যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল, সেই বীরদের স্মরণে তৈরি করা হয় স্মৃতি স্তম্ভ এবং এই পার্কের নামকরণ করা হয় বাহাদুর শাহ পার্ক।
সেসব বীরদের ইতিহাস মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র চলছে উল্লেখ করে বক্তারা বলেন, সেই ইতিহাসকে সংরক্ষণ না করে এবং নতুন প্রজন্মের মাঝে গৌরবোজ্জ্বল এই ইতিহাস না ছড়িয়ে ঐতিহাসিক সাহসী বীরদের ইতিহাস মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র করছে। পার্কের অভ্যন্তরে ফুড ভ্যানসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণের পাঁয়তারা চালাচ্ছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। এই ধরনের অবিবেচনা প্রসূত, অযৌক্তিক, অপরিনামদর্শী গণবিরোধী সিদ্ধান্ত বন্ধের দাবিতে বাহাদুর শাহ পার্ক সংরক্ষণ পরিষদ, বাহাদুর শাহ পার্ক প্রাতঃভ্রমণকারী সংঘসহ বিভিন্ন সংগঠন ও এলাকাবাসীর অব্যাহত প্রতিবাদ থাকা সত্ত্বেও সিটি করপোরেশন জনমতকে উপেক্ষা করে তাদের খামখেয়ালি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অনড় রয়েছে। যা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা মনে করি, বাহাদুর শাহ পার্কের অভ্যন্তরে এই ধরনের বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের কোনো যৌক্তিকতা নাই। এই ধরনের বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মিত হলে এই ঐতিহাসিক স্থানের শুধুমাত্র মর্যাদাই ক্ষুণ্ন হবে না, একই সঙ্গে এই এলাকার স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষাধিক শিক্ষার্থীসহ এলাকাবাসীর অবসর বিনোদন, অক্সিজেন গ্রহণ ও শরীর চর্চার একমাত্র স্থানটি বেদখল হয়ে যাবে। যা কোনো বিবেকবান মানুষই মেনে নিতে পারে না।
সমাবেশে উপস্থিত নেতারা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রকে উদ্দেশ্য করে বলেন, নগর পিতার মতো মানুষের সামান্য অর্থের বিনিময়ে (সূত্র মতে বাৎসরিক
প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা) অথবা কোনো ধরনের স্বজনপ্রীতির দোষে দুষ্ট হয়ে জনস্বার্থবিরোধী এই সর্বনাশা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে গণ শত্রুতে পরিণত হওয়া সাধারণ মানুষ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না। তাই আগামী ৭ দিনের মধ্যে পার্কের অভ্যন্তরে ফুড ভ্যানসহ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণের জন্য যে লোহা ও কনক্রিটের কাঠামো তৈরি করা হয়েছে তা তুলে নিয়ে সাধারণ মানুষ যাতে নির্বিঘ্নে পার্কে শরীর চর্চাসহ অবসর বিনোদন গ্রহণ করতে পারে তার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। স্মৃতিস্তম্ভের গায়ে ‘১৮৫৭ সালের শহীদদের স্মরণে’ লেখাটি দৃশ্যায়িত করে পুনর্লিখন করতে হবে। নতুন প্রজন্মকে প্রকৃত ইতিহাস জানানোর স্বার্থে বাহাদুর শাহ পার্কের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস সিটি করপোরেশন কর্তৃক জনসম্মুখে দৃশ্যমান জায়গায় টানাতে হবে। নগর জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত দখলকৃত সব পার্ক, পুকুর, খাল, বিল ও নদী দখলমুক্ত করে নগরবাসীর জন্য ব্যবহার উপযোগী করা এবং কোনোরকম ফি ছাড়াই উন্মুক্ত রাখতে হবে।
পার্কের ভেতরে দোকান দেওয়ার ব্যাপারে ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন বলেন, ‘আমরা প্রথমে বিষয়টি বুঝতে পারিনি। এখন ইজারাপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষকে স্থায়ী স্থাপনা ভেঙে ফেলার জন্য বলেছি। তারা ভ্রাম্যমাণ খাবার দোকান করবে। এজন্য একটি নকশা করে দেওয়া হয়েছে। দোকান পরিচালনার পাশাপাশি তাদের দায়িত্ব থাকবে পার্ক পরিষ্কার করা। পার্কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।’
পার্কের স্মৃতি রক্ষার জন্য নতুন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, শিগগিরই মিটিং করে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাব।
এমবি/এসজি