ভিক্টোরিয়া পার্কে খাবারের দোকান নির্মাণ
ঢাকা শহরের নাগরিক জীবনের ভিড়ে একটু স্বস্তি দিতে পারে পার্ক কিংবা গাছপালাসমৃদ্ধ জায়গা। পুরান ঢাকার বুকে মানুষকে সবুজ প্রকৃতির ছোঁয়া দিতে পারে বাহাদুর শাহ পার্ক। এটি ভিক্টোরিয়া পার্ক নামেই বেশি পরিচিত। এবার সেই পার্কেই ভেতরে খাবারের দোকান নির্মাণ করা হচ্ছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) পার্কের ঠিক মাঝখানে দোকান বসানোর জন্য এক ব্যক্তিকে ইজারা দিয়েছে বলে জানা গেছে। নিয়মিত পার্কে হাঁটাচলা করা এবং স্থানীয় জনসাধারণের বিরোধিতার মধ্যেও এর নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন উদ্যোক্তারা।
স্থানীয় বাসিন্দারা পার্কের মধ্যে স্থায়ী দোকান নির্মাণ শুরুর পর থেকে প্রতিবাদ করে আসলেও তা বন্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আরও কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা দিয়েছেন তারা। গণস্বাক্ষর কর্মসূচি অব্যাহত। প্রয়োজনে এর নির্মাণ বন্ধে আদালতে রিট করবেন বলেও জানান তারা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, গত মঙ্গলবার ইজারাদারের লোকজন লোহার অ্যাঙ্গেলসহ অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী পার্কে নিয়ে আসার পরই লোকজন তাদের বাধা দেয়। তারমধ্যেও কিছু কাজ করে ফেলায় বুধবার সকালে যারা হাঁটতে আসেন তারা সবাই মিলে সব ভেঙে ফেলেন। পার্কে সকালে সবাই বিক্ষোভও করেন এমন স্থাপনা নির্মাণের প্রতিবাদে।
পরে গত বুধবার বেলা ১১টার দিকে দেখা যায়, যেখানে স্থাপনা হচ্ছে সেখানে বেশ কজন পুলিশ বসে আছেন। পাশে শ্রমিকরা কাজ করছেন। বৃহস্পতিবার সকালেও একইভাবে কাজ করতে দেখা গেছে।
নির্মাণ শ্রমিকরা যেখানে রান্নাঘর হবে সেখানে লোহার স্থাপনা গড়ার কাজ মোটামুটি শেষ করেছেন। পরে খাবারের দোকান নির্মাণে হাত দেবেন। একাধিক শ্রমিকের সঙ্গে কথা বললেও কারা ইজারা পেয়েছেন সে নিয়ে তারা কিছু বলতে রাজি হননি।
যেখানে কাজ করা হচ্ছে সেখানে ছোট ব্যানার টাঙানো দেখা গেছে। যাতে লেখা আছে- ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কর্তৃক অনুমোদিত ও ইজারাকৃত ফুডভ্যান নির্মাণের কাজ চলছে।
এদিকে এমন ঐতিহাসিক স্থাপনার মধ্যে স্থায়ীভাবে খাবারের দোকান নির্মাণ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে সমালোচনা করছেন। এদিকে গত শুক্রবার সকালে পার্কের চারপাশে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে বাহাদুর শাহ (ভিক্টোরিয়া) পার্ক সংরক্ষণ পরিষদ।
ব্যস্ত রাজধানীর মাঝে একটুখানি সবুজের সমারোহ নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে বাহাদুর শাহ পার্ক। নানান ইতিহাসের সাক্ষী এই পার্কে ব্যস্ত শহরে স্বস্তির নিঃস্বাস ফেলতে আশেপাশের অনেকেই নিয়মিত আসেন। অনেকে আবার সকাল-বিকাল-রাতের বেলা নিয়ম করে হাঁটতে বের হন। নিয়মিতই শতাধিক লোককে পার্কে শরীরচর্চা ও হাঁটতে দেখা যায়।
এ ছাড়া বাহাদুর শাহ পার্ক পুরান ঢাকার খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থানে অবস্থিত। এটি ঢাকার সদরঘাট এলাকায় ঢুকেই লক্ষ্মীবাজারের ঠিক মাথায় অবস্থিত। এর চারপাশ ঘিরে রয়েছে সাতটি রাস্তার সমাহার।
চারপাশে রয়েছে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, সেন্ট থমাস চার্চ ও ঢাকায় প্রথম পানি সরবরাহ করার জন্য তৈরি ট্যাংক।
এ ছাড়া এর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে রয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, উত্তর পশ্চিম দিকে রয়েছে ঢাকার জজকোর্ট। আরও অনেক জনগুরুত্বপূর্ণ সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যমনি হয়ে অবস্থান করছে কালের সাক্ষী এই বাহাদুর শাহ পার্ক বা আন্টাঘর ময়দান। বর্তমানের এই বাহাদুর শাহ পার্ক বাংলার সংগ্রামী ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী।
ফলে এখানে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের আনাগোনা হয়। এতে এমনিতেই পরিবেশ ভালো নেই। তারমধ্যে পার্কটির ঠিক মাঝখানে একটি রান্নাঘরসহ খাবারের দোকান হলে পরিবেশ আরও নষ্ট হয়ে পড়বে এমন আশঙ্কা করে স্থানীয়রা বিরোধিতা করছেন বলে দাবি করেছেন।
৮৫ কাঠারও বেশি আয়তনের পার্কটিতে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও দিনে দিনে অনিরাপদ হয়ে উঠছে দর্শনার্থীদের জন্য। আগে লোহার গ্রিল দিয়ে পুরো পার্ক আটকানো থাকলেও এখন পুরোটা খোলা। এই সুযোগে পার্কে আসা মানুষদের প্রায়ই পড়তে হয় ছিনতাইকারীদের কবলে। শুধু তাই নয়, সংস্কারকাজ শেষ হওয়ার পর থেকেই এই পার্কে বেড়েছে নানা ধরনের অপরাধ। অনেকটা অপরাধীদের অভয়াশ্রমে পরিণত হয়েছে এই পার্কটি। স্মৃতিসৌধের উপরে চলে মাদকের আড্ডা। মাদকাসক্ত অনেক পথশিশু ও কিশোরদের আবাস্থলে পরিণত হয়েছে এই পার্কটি। মাদক ব্যবসার মূল কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহার করছে কয়েকটি সিন্ডিকেট।
বর্তমানে আশপাশে ভ্রাম্যমাণ হকাররা খাবারের পসরা সাজিয়ে বসায় এমনিতেই পার্কের চারপাশের সৌন্দর্য নষ্ট হওয়ার পথে। নিয়মিত পার্কে আসা লোকজন বলছেন, স্থায়ীভাবে এখানে খাবারের দোকান হলে পার্কের সৌন্দর্য পুরোপুরি নষ্ট হয়ে হবে। তখন মানুষের হাঁটাচলা করার সুযোগও আর থাকবে না। দোকান হলে পার্কের গাছগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ঐতিহ্যবাহী পার্কটি ২০২০ সালে সাজানো হয় নতুন আঙ্গিকে। বিপুল অংকের টাকা খরচ করে সংস্কারের মাধ্যমে এর আধুনিকায়ন করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এখন সেখানে বসানো হচ্ছে স্থায়ী খাবার দোকান।
সুমন বণিক নামের একজন ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আমরা সকালে এখানে হাটতে আসি, অনেক লোক আসে। কেন এখানে এটা করা হবে? চারপাশে অনেক দোকান আছে খাবারের এটা না হলেও হবে। আশেপাশে অনেক হকার এমনিই এর পরিবেশ নষ্ট করছে আর নষ্ট না হউক।
রায়হান উদ্দিন নামের একজন স্থানীয় বাসিন্দা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ঢাকার ভেতর এমনিই পার্কের অভাব, সবুজে সবুজ পরিবেশ নেই বললেই চলে। পুরান ঢাকায় আরও নেই, এখানে খাবারের দোকান দেওয়ার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই, এতে পার্কের পরিবেশ নষ্ট হবে, পার্ক তার নিজস্বতা হারাবে।
এবিষয়ে জানতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিনকে ফোন দেওয়া হলেও নম্বর বন্ধ থাকায় যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
এসএন