রং তুলিতে প্রতিমা সাজাতে ব্যস্ত মৃৎশিল্পীরা
দশ হাতে দশ ভুজা নিয়ে আগমন ঘটছে দেবী দুর্গার। প্রকৃতিও যেন জানান দিচ্ছে সেই বার্তা। আকাশের নীল ও মেঘ এবং জমিনের সাদা কাশফুল যেন তারই আগমনী গান গাচ্ছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। সেই পূজা উপলক্ষে দেশজুড়ে চলছে প্রতিমা তৈরির কাজ।
প্রায় চারশ' বছরের অধিক সময় নানান সংস্কৃতি ও স্থাপনার জন্য বিখ্যাত রাজধানী ঢাকা। এ শহরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জায়গা পুরান ঢাকা। প্রতি উৎসবেই যেন নিজেকে জানান দেয় নতুন রূপে। মাটির প্রলেপে শিল্পীর তুলির ছোঁয়ায় পূর্ণতা পাচ্ছে দেবী দুর্গার প্রতিমা।
এবারের দুর্গাপূজা আগামী ১ অক্টোবর (১৪ আশ্বিন) ষষ্ঠী পূজা দিয়ে শুরু করে ৫ অক্টোবর (১৮ আশ্বিন) বিজয়া দশমী দিয়ে শেষ হবে। করোনা না থাকায় এবারের আমেজ যেন বাধনহীন। ঢাকার বিভিন্ন স্থানের পূজা উদযাপন কমিটিসহ অন্যান্য সংগঠনের নেই দম ফেলার অবকাশ। সারা রাত জেগেও কাজ করছেন অনেক শিল্পীরা। নিজের সর্বোচ্চ কারিগরি দক্ষতা দিয়ে ফুটিয়ে তুলছেন বাহারি কারুকাজ।
পুরান ঢাকার সূত্রাপুর, কাঠেরপুল, একরামপুর, শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার, লক্ষ্মীবাজার, শ্যামবাজার, পাটুয়াটুলি, প্যারীদাস রোড, কলতাবাজার, মুরগিটোলা, মদনমোহন দাস লেন, গোয়ারনগর, বাংলাবাজার জমিদারবাড়ী, গেন্ডারিয়া, ডালপট্টি, কুলুটোলাসহ বিভিন্ন এলাকায় চলছে প্রতিমা নির্মাণের কাজ। নানা সংগঠন মণ্ডপের পাশে বানাতে শুরু করেছেন মঞ্চ। প্রতিমা বানানোর জন্য পাশেই রাখা হয়েছে কাদা-মাটি, বাঁশ, খড়, সুতলি, রংসহ নানান উপকরণ। এসব উপকরণ দিয়ে বানানো হচ্ছে নানান প্রতিমা।
কারিগররা সাধারণত অজন্তা ধাঁচের প্রতিমা বানিয়ে থাকেন। এগুলো ওরিয়েন্টাল প্রতিমা হিসেবে পরিচিত। অজন্তা ধাঁচের প্রতিমার চাহিদা এখন বেশি। এ ধরনের মূর্তিতে শাড়ি, অলংকার ও অঙ্গসজ্জা সবই করা হয় মাটি ও রং দিয়ে।
এ বছর পুরান ঢাকায় নবকল্লোল পূজা কমিটি, শ্রীশ্রী শিব মন্দির, প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব, সংঘমিত্র পূজা কমিটি, শ্রীশ্রী রাধা মাধব জিউ দেব মন্দির, নতুন কুঁড়ি পূজা কমিটি, নববাণী পূজা কমিটি, রমাকান্ত নন্দীলেন পূজা কমিটিসহ আরও বেশ কিছু ক্লাব পূজা আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছে। তবে শিবমন্দির, তাঁতী বাজার, সঙ্গ মিত্র, প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব, গোয়ালনগর ঘাট, জুলন বাড়ীতে বড় পূজার আয়োজন করা হচ্ছে।
এবার ঢাকায় ২৪১টি মন্দিরে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে মহানগর দক্ষিণে ১৫৪টি ও উত্তরে ৮৭টি। সবচেয়ে বেশি পূজা অনুষ্ঠিত হবে পুরান ঢাকার সূত্রাপুর থানায়। এখানে মোট পূজার সংখ্যা ২৫টি।
দুর্গোৎসব দুর্গাপূজার প্রধান উপকরণ হচ্ছে মা দুর্গার প্রতিমা। এ ছাড়াও লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, অসুরসহ বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি। দেবী দুর্গা ও তার বাহন সিংহের প্রতিমাসহ তৈরি করা হচ্ছে যাকে বধের জন্য দেবীর আগমন সেই মহিষাসুরের প্রতিমা। একই সঙ্গে তৈরি হচ্ছে দেবী লক্ষ্মী, সরস্বতী, দেবতা কার্তিক, গণেশ, এবং তাদের বাহন পেঁচা, রাজহাঁস, ইঁদুর আর ময়ূর। প্রতিমা তৈরির মাঠগুলো ঘুরে এমনটিই লক্ষ্য করা যায়।
মৃৎশিল্পীরা বলেন, প্রতিবছর এই সময়ের জন্য আমরা অপেক্ষা করি। এটি শুধু আমাদের পেশা নয় আমাদের নেশাও। মন থেকে ভালোবাসি এই কাজ করতে।
বাংলাবাজারের মৃৎশিল্পী বলাই পাল জানান, আমরা প্রতিবছরেই অনেক প্রতিমা তৈরি করি। এবারও সেই লক্ষ্যেই কাজ করছি। ৪০ হাজার টাকা থেকে ৪ লাখ টাকার মধ্যে এসব প্রতিমা নির্মাণ করা হয়। আমাদের কাছে অনেক জায়গা থেকে অনেকেই আসে প্রতিমা নেওয়ার জন্য।
দুর্গাপূজার উপকরণ কিনতে ময়মনসিংহ থেকে শাঁখারীবাজারে এসেছেন উত্তম পাল। তিনি জানান, শাঁখারীবাজারে আমরা প্রতিবছরই আসি। এখানে সব উপকরণ একসঙ্গে পাওয়া যায়, অন্যান্য জায়গার চেয়ে দাম কম পাওয়া যায়।
প্রতিমা তৈরিতে আগের মতো আর কারিগর পাওয়া যায় না বলে জানান মৃৎশিল্পে আন্তর্জাতিক পদক পাওয়া শাঁখারীবাজারের প্রাচীন প্রতিমা শিল্পী হরিপদ পাল। তিনি বলেন, প্রতিমা তৈরির কাজে এখন অনেকের আগ্রহ নেই। আগের চেয়ে মুনাফা এখন কম। এই সময় সবকিছুর দাম বাড়ছে, কিন্ত মূল্য বাড়েনি শিল্পীদের। এই পেশায় অনেকেই এখন আসতে চায় না, তবে অনেকেই ভালোবেসে এখনো এই কাজ করছে।
এসজি