নতুন ড্যাপের সংশোধনী চান বিক্ষুব্ধ জমির মালিকরা
‘আমি কষ্ট করে আড়াই কাঠা জমি কিনেছি। আমার পাশের প্লট মালিক সে আমার সঙ্গে একত্রে ভবন করতে রাজি না হলে বা ভবন করার মতো তার সামর্থ্য না থাকলে আমি কী করব? বিভিন্ন হাউজিংয়ে আড়াই কাঠার প্লট আছে তারা কি করবে? বিষয়টি কর্তৃপক্ষের ভেবে দেখা উচিত।’ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এভাবেই নিজের কষ্টের কথা লিখেছেন জয়নুল আবেদিন পাশা। যিনি এই নগরে একজন ছোট প্লট মালিক।
বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার পর জয়নাল আবেদিন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন।
দ্বিনাথ বিশ্ব নামে আরেকজন লিখেছেন, ‘রাজউকের এরূপ সিদ্ধান্ত অল্প অর্থের মালিকদের আশা ও স্বপ্নে ছাই ঢেলে দিল। যা আদৌ কোনো জনসিদ্ধান্ত হতে পারে না। রাজউকের উচিত হবে অন্যভাবে পরিকল্পনা করে পুনরায় বিষয়টির সিদ্ধান্ত নেওয়া।’
শুধু পাশা বা দ্বিনাথ নয়, রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় যারা ছোট ছোট প্লটের মালিক তারাও এখন কঠিন সংকটে পড়েছেন। কারণ ড্যাপের নিয়ম অনুযায়ী ছোট জমির মালিকরা এককভাবে বাড়ি নির্মাণ করতে পারবেন না। ব্লকভিত্তিক নির্মাণকাজ হলে তাদের অন্য জমি মালিকের সঙ্গে যৌথভাবে ভবন নির্মাণ করতে হবে। এ কারণে ক্ষুব্ধ এসব জমি মালিকরা চান নতুন ড্যাপের সংশোধনী।
অপরদিকে, আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবও বলছে, নতুন নিয়মের কারণে ফ্ল্যাটের দাম বেড়ে যাবে ৫০ শতাংশ।
এদিকে নতুন ড্যাপের প্রজ্ঞাপনকে চ্যালেঞ্জ করে একজন প্লটমালিক ও আইনজীবী ইতোমধ্যে হাইকোর্টে একটি রিটও করেছেন।
গত ২৪ আগস্ট নতুন ড্যাপের (২০১৫-২০৩৫) প্রজ্ঞাপন জারি করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। তারপর থেকে স্টেকহোল্ডাররা নানা ধরনের মতামত দিচ্ছেন।
ব্লকভিত্তিক উন্নয়ন কী?
নতুন ড্যাপের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, জমির স্বল্পতা থাকায় অপেক্ষাকৃত কম জমিতে সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে ব্লকভিত্তিক উন্নয়ন জরুরি। এর উদ্দেশ্য হলো ছোট ছোট প্লটকে একত্র করে পর্যাপ্ত উন্মুক্ত জায়গা রেখে সুউচ্চ ভবন নির্মাণ।
ব্লকভিত্তিক উন্নয়নের উদ্দেশ্য নিয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অপরিকল্পিতভাবে নগরাঞ্চলের সম্প্রসারণ কমিয়ে আনা এবং বন্যাপ্রবাহ অঞ্চল ও কৃষিজমি সুরক্ষাও এমন উন্নয়ন পরিকল্পনার উদ্দেশ্য।
আবাসন ব্যবসায়ীরা যা বলছেন
প্লটভিত্তিক ব্যবস্থার পরিবর্তে ব্লকভিত্তিক ব্যবস্থা চালু করায় আবাসনখাত হুমকির মুখে পড়বে বলে মনে করেন আবাসন ব্যবসায়ীরা। এই ব্যবস্থায় ভবনের আকার ৩৩ থেকে ৫৩ শতাংশ কমবে। এতে ফ্ল্যাটের দামও ৫০ শতাংশ বেড়ে যাবে। যা ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতাকে প্রভাবিত করবে।
জানতে চাইলে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সহ-সভাপতি কামাল মাহমুদ ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, সাধারণ জমির মালিক যাদের ছোট ছোট জমি আছে তারা বেশি সমস্যায় পড়বে। কারণ এখনো ৭০ ভাগ বাড়িই ৩ থেকে ৪ তলা।
রিহ্যাবের সহ-সভাপতি বলেন, মানুষের উপার্জনের সিংহভাগ টাকাই চলে যায় বাড়ি ভাড়ায়। ড্যাপের এই নতুন নীতিমালার কারণে এসব ভাড়াটিয়া আরও সমস্যায় পড়বেন। ভাড়া বেড়ে যাবে। ফলে সাবলেটের সংখ্যা বাড়বে।
এক প্রশ্নের জবাবে কামাল মাহমুদ বলেন, ভাইয়ে ভাইয়েই বিবাদ লেগে থাকে। সেখানে অন্যের সঙ্গে জমি শেয়ার করে কীভাবে প্লট করবে? এটা একটা জুলুমের মতো হয়ে গেছে।
রিহ্যাব সাংগঠনিকভাবে কোনো পদক্ষেপ নেবে কী না এমন প্রশ্নের জবাবে সহ-সভাপতি বলেন, রিহ্যাব তো একটা সংগঠন। ড্যাপের গেজেট হওয়ার আগে আমরা বহুবার সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেছি। তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। অথচ প্রজ্ঞাপন জারির পর দেখা গেল আমাদের কোনো কথা তারা রাখেননি।
কামাল মাহমুদ বলেন, পূর্বাচলে বরাদ্দ পাওয়ার পর ৩/৪ কিস্তি দিলেই সেটি এক কোটি টাকা কাঠা বিক্রি করতে পারে। সেই প্লটে কবে বাস করা যাবে তার ঠিক নেই। অথচ যে প্লটে মানুষ বংশ পরম্পরায় বসবাস করছে সেই প্লটে আপনি ২/৩ তলার উপরে করতে পারবেন না এটা কেমন কথা? এটা খুবই অমানবিক ব্যাপার।
রাজউক যা বলছে
অবশ্য ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক ও নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম এ বিষয়টি মানতে নারাজ। সম্প্রতি ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) আয়োজিত এক সেমিনারে তিনি এ ব্যাপারে বলেন, আবাসন ব্যবসায়ীরা যেটা বলছেন সেটা সঠিক না।
আশরাফুল ইসলাম দাবি করেন, ড্যাপের প্রস্তাবনাসমূহের সঠিক বাস্তবায়ন করা হলে এই শহরে নিম্ন আয়ের লোকদের জন্য লক্ষাধিক আবাসিক ইউনিট তৈরি করা সম্ভব হবে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়ন পরিকল্পনা ও কার্য পরিকল্পনাসমূহ প্রণয়ন করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের এই পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্মাণকাজ করার আন্তরিকতা থাকলে বাস্তবায়ন সহজ হবে।
যা বললেন রিটকারী আইনজীবী
ড্যাপের গেজেটের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ। রিটে গণপূর্ত অধিদপ্তর ও রাজউকের চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রিটকারী আইনজীবী ইউনুস আলী আকন্দ শুক্রবার (১৬ সেপ্টেম্বর) ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, নতুন গেজেট অনুযায়ী অন্যদের মতো আমিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় আমার ৫ কাঠার একটি প্লট রয়েছে, যেটা ২০১০ সালের পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত ছিল না। নতুন প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী আমার প্লট ড্যাপের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তাই প্রজ্ঞাপনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করেছি।
এক প্রশ্নের জবাবে ইউনুস আলী আকন্দ বলেন, রিট ফাইল করেছি। শুনানির তারিখ এখনো পাইনি। আইন আমার পক্ষে আছে। আমি জিতব।
এনএইচবি/আরএ/