ড্যাপ বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় নগর পরিকল্পনাবিদদের
রাজধানীর বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকেই তাদের এই সন্দেহ-সংশয়।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, ২০ বছর মেয়াদি পূর্ববর্তী ড্যাপ (১৯৯৫-২০১৫) যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হলে এখন রাজধানী ঢাকার চেহারা হতো অন্যরকম। কিন্তু রাজনৈতিক, প্রশাসনিক হস্তক্ষেপসহ নানা চাপে ড্যাপ তেমন বাস্তবায়ন হয়নি। সঙ্গত কারণেই নতুন ড্যাপ বাস্তবায়ন নিয়েও যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।
সম্প্রতি ঢাকার জন্য বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। এই ড্যাপ কার্যকারিতার মেয়াদ ২০১৬ সাল থেকে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত।
কিন্তু ১৯৯৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত মেয়াদি ড্যাপে অন্তত চার লাখ স্থাপনা রয়েছে। যেগুলোর অবস্থান রাজধানীর বন্যাপ্রবণ অঞ্চলে। নানামুখী চাপের কারণে সেই স্থাপনাগুলো সরানো যায়নি। এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন খোদ ঢাকা মহানগরীর সংসদ সদস্যরা। তাদের ভোট রাজনীতির কারণে জলাশয় শ্রেণির ভূমিতে গড়ে উঠা এ সব স্থাপনা সরানো যায়নি। বরং এ সব ঝুঁকিপূর্ণ লাখ লাখ স্থাপনা বছরের পর বছর ধরে আছে। সেই বিবেচনায় সেগুলোকে এক ধরনের ‘দায়মুক্তি’ দেয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)।
সেই সময় ড্যাপ বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়ানো ঢাকার সংসদ সদস্যরা নিজ নিজ এলাকার ভোটারদের পক্ষে রাজউকে সুপারিশ করতেন। সুপারিশ করতেন যাতে এ সব স্থাপনাকে বন্যাপ্রবণ অঞ্চলে দেখানো না হয়। অবস্থা এমন হয়েছিল যে সেই সময় ঢাকার সংসদ সদস্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে রাজউকের বিরুদ্ধে ‘বিচার’ পর্যন্ত দিয়েছিলেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিকল্পনার সফলতা কিংবা ব্যর্থতা নির্ভর করে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকারের সদিচ্ছার উপর। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আন্তরিক সদিচ্ছা, যথাযথ প্রয়োগ, প্রয়োজনীয় অর্থায়ন, উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ, আইনের শাসন ও জনস্বার্থ-জনকল্যাণ রক্ষায় পরিকল্পনা ও নীতি-নির্দেশনার নির্মোহ ও যথাযথ বাস্তবায়নের উপর। অতীতে ঢাকা মহানগরীর জন্য প্রণীত কাঠামোগত পরিকল্পনা, মহাপরিকল্পনা কিংবা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা দলিলগুলো সঠিক ও পূর্ণ বাস্তবায়নের অভাবেই ঢাকা ক্রমান্বয়ে বাসযোগ্যতা হারিয়েছে।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলেন, অনেক ক্ষেত্রেই ড্যাপকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেই অনুমোদনহীন শিল্প-কারখানা কিংবা ভবন নির্মাণ হয়েছে। ভূমি ব্যবহার নির্দেশনার ব্যত্যয় ঘটিয়ে জলাধার, নদী, খাল, বন্যা প্রবাহ অঞ্চল ভরাট করা হয়েছে। ফলে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ হওয়ায় একটু বৃষ্টিতেই রাজধানী ঢাকার অনেক এলাকা দীর্ঘসময় ধরে তলিয়ে থাকে৷ ড্যাপকে পাশ কাটিয়ে জলাভূমিতে স্থাপনা নির্মাণ করার কারণে ঢাকায় অপরিকল্পিত নগরায়ন হয়েছে, বাসযোগ্যতা কমেছে মারাত্মকভাবে। ফলে ঢাকা ক্রমশ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
এবারের ড্যাপেও আধুনিক নগর পরিকল্পনার বেশ কিছু কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ব্লক ডেভেলপমেন্ট, কমিউনিটিভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা ও সেবার বিকেন্দ্রীকরণ, মেট্রো স্টেশনভিত্তিক ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট (টিওডি), জনঘনত্ব জোনিং, ট্রান্সফার অব ডেভেলপমেন্ট রাইট (টিডিআর), ওয়ার্ডভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা এবং মানসম্পন্ন সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিনোদনকেন্দ্র সৃষ্টি ইত্যাদি। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আঞ্চলিক পার্ক, জলকেন্দ্রিক পার্ক, ইকোপার্ক তৈরি, পথচারীবান্ধব অবকাঠামো তৈরি ও বাইসাইকেল লেনকে উৎসাহিত করা এবং অযান্ত্রিক পরিবহনকে সামগ্রিক পরিকল্পনার সঙ্গে সমন্বয় করা— এ সব বিষয় ড্যাপে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।
ব্লকভিত্তিক ডেভেলপমেন্ট হলো আগে যেমন ছোট ছোট জমির উপরে ফ্ল্যাট হতো এখন সেটা আর থাকবে না। এখন ছোট ছোট জমিকে একত্রিত করে বড় অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স করা হবে। এ ব্যাপারে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) কামাল মাহমুদ ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, এখনো ৭০ ভাগ বাড়ি ছোট ছোট জমির উপর ৩/৪ তলা। ড্যাপে ব্লকভিত্তিক ব্যবস্থা থাকায় এমন সুযোগ থাকবে না। এর ফলে খরচও বেড়ে যাবে।
ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ড্যাপে প্রস্তাবিত সব পরিকল্পনা কৌশলের সফলতা নির্ভর করবে তার যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের উপর। এজন্য ঢাকা মহানগর এলাকায় কার্যরত স্থানীয় সরকারসমূহ যেমন সিটি করপোরেশনসহ অন্যান্য সংস্থাসমূহকে ড্যাপ অনুযায়ী এলাকাভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা দ্রুত প্রণয়ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি আকতার মাহমুদ বলেন, ড্যাপের আওতাভুক্ত এলাকার আয়তন এক হাজার ৫২৮ কিলোমিটার। এই বিশাল এলাকা নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা রাজউকের নেই।
জানতে চাইলে ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, রাজউক এক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করে। ফলে রাজউকের সক্ষমতার সমস্যা নেই।
এনএইচবি/আরএ/