‘ক্রেনের ফিটনেস না থাকায় দুর্ঘটনা’
রাজধানীর উত্তরায় ১৫ আগস্ট বিকাল সাড়ে চারটার দিকে প্রাইভেট কারের উপর নির্মাণাধীন বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের গার্ডার পড়ার সময় ক্রেনটি চালাচ্ছিলেন চালকের সহকারী রাকিব। আর বাইরে থেকে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন মূল অপারেটর আল আমিন। তাদের গাফিলতি ও ক্রেনের ধারণ ক্ষমতা না থাকায়, এটি পড়ে ৫ জন নিহতের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
র্যাব জানায়, তদন্তে জানা গেছে, ২০২১ সালে সর্বশেষ ফিটনেস যাচাই করা হয়, এরপর ক্রেনটির আর ফিটনেস যাচাই করা হয়নি। র্যাব বলছে, এর মধ্যে গ্রেপ্তারকৃত রুবেল তিন মাস আগে ও গ্রেপ্তার আফরোজ গত মাসে ফোর ব্রাদার্স গার্ডস সার্ভিস ট্রাফিকম্যান হিসেবে এ প্রকল্পে যোগ দেন। তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা বিষয়ক কোনো প্রশিক্ষণও ছিল না। দুর্ঘটনার সময় তারা সেখানে প্রকল্পের ট্রাফিকম্যান হিসেবে নিয়োজিত ছিল। তাদের যদি যথাযথ প্রশিক্ষণ থাকত তাহলে হয়তো এই দুর্ঘটনাটি ঘটত না।
র্যাব বলছে, এসব অভিযোগের ভিত্তিতে নয় জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বুধবার (১৮ আগস্ট) তাদের রাজধানীর জুরাইন, যাত্রাবাড়ী, কালশী, সাভার গাজীপুর, সিরাজগঞ্জ ও বাগেরহাটের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন-মো. আল আমিন হোসেন হৃদয়, সহকারী রাকিব হোসেন, দুর্ঘটনাস্থলে নিরপাত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ফোর ব্রাদার্স গার্ড সার্ভিসের ট্রাফিকম্যান মো. রুবেল, মো. আফরোজ মিয়া, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সেফটি ইঞ্জিনিয়ার মো. জুলফিকার আলী শাহ, হেভি ইকুইপমেন্ট সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত ইসকন বাংলাদেশ লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী মো. ইফতেখার হোসেন, হেড অব অপারেশন মো. আজহারুল ইসলাম মিঠু, ক্রেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বিল্ড ট্রেড কোম্পানির মার্কেটিং ম্যানেজার তোফাজ্জল হোসেন তুষার, প্রশাসনিক কর্মকর্তা রুহুল আমিন মৃধা।
বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অবস্থিত র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, রাজধানীর উত্তরায় বিআরটি প্রকল্পের যে ক্রেন থেকে প্রাইভেট কারের উপর গার্ডার পড়েছে সেটির সক্ষমতা ছিল ৪৫-৫০ টন। কিন্তু দুর্ঘটনার সময় ক্রেনে যে গার্ডার ছিল সেটির ওজন ছিল ৬০-৭০ টন। বিআরটি প্রকল্পের থার্ড পার্টি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিল্ড ট্রেড ইঞ্জিনিয়ার লিমিটেড মাসিক ভাড়ার চুক্তিতে ক্রেনটি সরবরাহ করে। ক্রেনটি আনুমানিক ১৯৯৬-৯৭ সালে আনা হয়েছিল। প্রথমে ক্রেনটির সক্ষমতা ৮০ টন ছিল। পরে আস্তে আস্তে ক্রেনটির সক্ষমতা কমে যায়। সর্বশেষ ক্রেনটির সক্ষমতা ছিল ৪৫-৫০ টন। অন্যদিকে, ক্রেনের ফিটনেস ছিল না।
মঈন আরও বলেন, আমরা গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পেরেছি, ক্রেনটির ফিটনেস ছিল না। অতিরিক্ত ভার বহন করায় ক্রেনটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। এ ধরনের গার্ডার শিফট করতে কাউন্টার লোড ব্যবহার করা উচিত ছিল। আরেকটি ক্রেন পাশাপাশি স্ট্যান্ডবাই রাখা উচিত ছিল। তা ছাড়া, ক্রেন নেওয়ার সময় নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এটি চালনা করা হয়নি।
তিনি বলেন, গত ১৫ আগস্ট রাজধানীর উত্তরার জসীম উদ্দিন রোডে বিকাল সোয়া চারটায় নির্মাণাধীন বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের ক্রেন থেকে গার্ডার ছিটকে প্রাইভেট কারের ওপরে পড়ে। এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই একই পরিবারের পাঁচ জনের মৃত্যু হয় এবং দুজন আহত হন। দুর্ঘটনার পর দ্রুততম সময়ে র্যাব সদরদপ্তরের উদ্ধার টিম ও র্যাব-১ এর একটি দল সর্বপ্রথম উদ্ধার কার্যক্রমে অংশ নেন।
পরবর্তী সময়ে ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে চার ঘণ্টাব্যাপী উদ্ধারকাজে চালিয়ে যায়। এসময় র্যাবের সহায়তায় অন্য একজন ক্রেন অপারেটর নিয়ে এসে গার্ডার উঁচু করে দুর্ঘটনা কবলিত গাড়ি এবং নিহতদের উদ্ধারে সহায়তা করা হয়। এ দুর্ঘটনায় ভুক্তভোগীদের পরিবারের পক্ষ থেকে ওই রাতেই রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় বিআরটির অবহেলাজনিত কারণে একটি মামলা করা হয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃদের বরাত দিয়ে মঈন বলেন, বিআরটি প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না গেজুবা গ্রুপ কোম্পানির (সিজিজিসি) তত্ত্বাবধানে ক্রেন দিয়ে প্রকল্পের গার্ডার উত্তোলনের কাজ চলাকালীন এ দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়। দুর্ঘটনায় ঘাতক ক্রেনের চালক-অপারেটর মো. আল আমিন ও হেলপার রাকিব হোসেনকে গ্রেপ্তার করি। তা ছাড়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিজিজিসি থেকে ভারী যন্ত্রপাতি সরবরাহের ওয়ার্ক অর্ডার পায় ইফসকন নামক একটি প্রতিষ্ঠান। যার স্বত্বাধিকারী গ্রেপ্তার ইফতেখার হোসেন ও হেড অব অপারেশন গ্রেপ্তার আজহারুল ইসলাম মিঠু। ভারী যন্ত্রপাতি ওঠানামার জন্য ইফসকনের কাছে বড় ক্রেন না থাকায় তারা থার্ড পার্টি প্রতিষ্ঠান বিল্ড ট্রেড কোম্পানির কাছ থেকে ক্রেনটি ভাড়া নেয়।
এ প্রকল্প এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্বে থাকা ফোর ব্রাদার্স গার্ড সার্ভিসের ট্রাফিক ম্যান আফরোজ ও রুবেল এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিজিজিসির সেফটি ইঞ্জিনিয়ার জুলফিকার আলীকে প্রকল্প এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং হেভি ইকুইপমেন্ট সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা সিজিজিসির প্রকিউরমেন্ট কর্মকর্তা মঞ্জুরুল ইসলামকে দায়িত্বে অবহেলার কারণে গ্রেপ্তার করা হয়। ঘাতক ক্রেনের মূল অপারেটর আল আমিন। তার হালকা গাড়ি চালানোর অনুমোদন থাকলেও ভারি গাড়ি চালানোর লাইসেন্স নেই। ২০১৬ সালে ক্রেন চালনার প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর দু-তিনটি নির্মাণ প্রকল্পে কাজ করে সে। ২০২২ সালের মে মাসে বিআরটি প্রকল্পে ক্রেন অপারেটর হিসেবে কাজ শুরু করে। গ্রেপ্তার রাকিব তিন মাস আগে এ প্রকল্পের ক্রেন হেলপার হিসেবে কাজ শুরু করে। তার ক্রেন চালনার কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছিল না। দুর্ঘটনার দিন আল আমিন ও রাকিব দুপুর ২টা থেকে ক্রেন চালনা শুরু করে। একটি গার্ডার স্থাপন শেষে দ্বিতীয় গার্ডার স্থাপনের সময় ক্রেনের ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত ওজনের গার্ডার উত্তোলনের কারণে ক্রেনটি নিয়ন্ত্রণ হারায়। এতে গার্ডারটি প্রাইভেটকারের ওপর ছিটকে পড়লে মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনা ঘটে। এসময় হেলপার রাকিব ক্রেন চালনা করছিল এবং ক্রেন অপারেটর আল আমিন ক্রেনের বাইরে থেকে নির্দেশনা দিচ্ছিল। দুর্ঘটনার পর অপারেটর আল আমিন ও হেলপার রাকিব ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, এটি ইফসকন কোম্পানি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিজিজিসি থেকে ভারী যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য ওয়ার্ক পারমিট পায়। গার্ডার বহনের ক্রেন এ প্রতিষ্ঠানের কাছে না থাকায় বিল্ড ট্রেডার্স নামক প্রতিষ্ঠান থেকে অপারেটর ও হেলপারসহ এ ক্রেনটি মাসিক চুক্তির ভিত্তিতে ভাড়া নেয়। ইফসকনের স্বত্বাধিকারী গ্রেপ্তার ইফতেখার ও হেড অব অপারেশন গ্রেপ্তার মিঠু অপারেটরদের দক্ষতা, যোগ্যতা ও ক্রেনের ফিটনেস যাচাই না করেই গুরুত্বপূর্ণ জনবহুল সড়কে ভারী গার্ডার স্থাপনের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। এ ছাড়া গার্ডার স্থাপনের সময় অতিরিক্ত একটি সহায়ক ক্রেন উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও সেটি ছিল না।
গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানান র্যাবের এই কর্মকর্তা।
কেএম/এমএমএ/