১৮ বছরে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়
গৌরব আর সাফল্যের ১৭ বছর পার করে যৌবনের ১৮ বছরে পা দিল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় (জাককানইবি)। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ময়মনসিংহের ত্রিশালের নামাপাড়া গ্রামের যে বট গাছের নিচে বাঁশি বাজাতেন সেই বটতলার কাছেই ২০০৬ সালের ৯ মে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উদযাপন উপলক্ষে দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি পালন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। মঙ্গলবার (৯ মে) সকালে প্রশাসনিক ভবনের সামনে জাতীয় সংগীত গেয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। জাতীয় পতাকা উত্তোলন শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু ও কবি নজরুলের ভাস্কর্যে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন শেষে শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অংশগ্রহণে একটি বর্ণাঢ্য আনন্দ শোভাযাত্রা এবং পায়রা অবমুক্তকরণ করা হয়।
২০ একর আয়তন নিয়ে শুরু হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়টিতে অনুষ্ঠানিকভাবে পাঠদান শুরু হয় ২০০৭ সালে ৩ জুন। প্রতিষ্ঠাকালীন অনুষদ ছিল ২টি ও বিভাগ ছিল ৪টি। এর মধ্যে কলা অনুষদের বিভাগ ছিল-বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ এবং সংগীত বিভাগ। বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদের অধীনে ছিল- কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ। উদ্বোধনী ব্যাচে শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল মাত্র ১৮৫ জন।
বর্তমানে ক্যাম্পাসের আয়তন বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৫৭ একর। এখন ৬টি অনুষদের অধীনে ২৪টি বিভাগে শিক্ষা কার্যক্রম চলমান আছে। ৭ হাজার ১৯৮ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে বর্তমানে কর্মরত আছেন ২১০ জন শিক্ষক, ১৪৩ জন কর্মকর্তা, ১৯৪ জন কর্মচারী। শিক্ষার্থীদের আবাসনে রয়েছে ৪টি আবাসিক হল। এগুলো হলো- অগ্নি-বীণা হল, দোলন-চাঁপা হল, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল। প্রায় তিন হাজারের অধিক শিক্ষার্থী হলগুলোতে অবস্থান করতে পারে। শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আবাসনের জন্য রয়েছে ৪টি ডরমিটরি। বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্য স্থাপনার মধ্যে রয়েছে- জয় বাংলা ভাস্কর্য, বঙ্গবন্ধু ভাস্কর্য, নজরুল ভাস্কর্য, চির উন্নত মম শির স্মৃতিস্তম্ভ। এ ছাড়া নির্মাণাধীন রয়েছে দৃষ্টিনন্দন লেক, বঙ্গবন্ধু স্কয়ার, শেখ রাসেল শিশু পার্কসহ নানা দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা।
বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রথম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পান অধ্যাপক ড. শামসুর রহমান। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টির ৬ষ্ঠ উপাচার্য হিসেবে নিযুক্ত আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর। তিনি ২০২১ সালে ১৯ ডিসেম্বর উপাচার্য হিসেবে যোগদান করেন।
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়টি উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রসরমান বিশ্বের সঙ্গে সংগতি রক্ষা ও সমতা অর্জন এবং জাতীয় পর্যায়ে উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণা, বিশেষ করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আধুনিক জ্ঞান চর্চা ও পঠন-পাঠনের সুযোগ সৃষ্টি ও সম্প্রসারণের রূপকল্প নিয়ে কাজ করছে। বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড.সৌমিত্র শেখর যোগদানের পর যেন বিশ্ববিদ্যালয়টি নতুন মাত্রা পেয়েছে। যোগদানের পরেই তিনি শিক্ষা,গবেষণা ও উন্নয়নকে প্রতিষ্ঠানের মূলমন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করেছেন। শিক্ষা, গবেষণা ও উন্নয়ন-এই তিন উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়ে বর্তমান প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়টিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়টিকে বিশ্বমানের করে গড়ে তুলতে বিশ্বের অন্যানা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী বিনিময়, গবেষণায় সহযোগিতা, বৃত্তি প্রদান, ইন্টার্নশিপসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা আদান-প্রদানের উদ্দেশে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- ভারতের কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়, আসাম ডাউনটাউন বিশ্ববিদ্যালয়, সিধু-কানহো-বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরানের ফেরদৌসি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশের রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় ও দ্য ইনফিনিটি মেরিটাইম রিসার্চ অ্যান্ড রোবোটিক টেকনোলজি লিমিটেড।
এ ছাড়া ভারতের আসানসোলের কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে নজরুলকে নিয়ে নির্মোহ গবেষণার উদ্দেশে গবেষণা পত্রিকা প্রকাশ করে আসছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। একাডেমিক কার্যক্রমে সেশনজট দূর করতে শিক্ষার্থীদের জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে একাডেমিক ক্যালেন্ডার। স্মার্ট ক্যাম্পাস বিনির্মাণে নেওয়া হয়েছে ডিজিটাল ফাইলিংয়ের উদ্যোগ।
নজরুল গবেষণাকে নতুনমাত্রা দিতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ইন্সটিটিউট অব নজরুল স্টাডিজ। যেখান থেকে প্রত্যেক বিভাগের শিক্ষার্থীকে নজরুলের উপর 'নজরুল স্টাডিজ' নামের -১০০ নম্বরের একটি কোর্স বাধ্যতামূলকভাবে পড়ানো হয়। নজরুল গবেষণায় আগ্রহী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রদান করা হয় গবেষণা বৃত্তি।
শিক্ষা-গবেষণার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বর্তমান সময়ে ক্যাম্পাসে চলছে সুবিশাল উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। একসঙ্গে চলমান আছে ২৩টি অবকাঠামো নির্মাণকাজ। একদিকে যেমন একাডেমিক ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে অন্যদিকে চলছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসিক ভবন, মসজিদ, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি), সম্প্রসারিত মেডিকেল সেন্টার, নতুন দুইটি আবাসিক হল, ইনস্টিটিউট ভবন,প্রশাসনিক ভবনসহ নানা ধরনের অবকাঠামো নির্মাণকাজ। ক্যাম্পাসের সুরক্ষার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে সীমানা প্রাচীর এবং সম্পূর্ণ ক্যাম্পাসকে সিসিটিভির আওতায় নিয়ে আসার জন্য আহ্বান করা হয়েছে দরপত্র।
সাংস্কৃতিক মননে পরিচালিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সারা বছরই উৎসবের আমেজ লেগে থাকে। প্রতিবছরই এখানে নজরুলজয়ন্তী, রবীন্দ্রজয়ন্তী ও বারামখানার উদ্যোগে লালন স্মরণোৎসব পালন করা হয়। মাসব্যাপী নাট্যোৎসব, চলচ্চিত্র উৎসব, পিঠা উৎসব, নজরুল বইমেলা, কুয়াশা উৎসব অন্যতম আকর্ষণীয় দিক। বিশেষত ভিন্ন আমেজের কুয়াশা উৎসব এখানকার অন্যতম জনপ্রিয় উৎসবে পরিণত হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড.সৌমিত্র শেখর শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, ‘শিক্ষা, গবেষণা ও উন্নয়ন এই তিনটিকে মটো করে আমাদের যে অভিযাত্রা সেই অভিযাত্রা চলমান আছে। আমরা মনে করি বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বমানে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে উপাদানগুলো প্রয়োজন সেই উপাদানগুলো ইতোমধ্যেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃষ্টি হয়েছে, এখন সেটিকে বিকশিত করার পালা। বিকশিত করার ক্ষেত্রে আমি শিক্ষক,কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ছাত্র-ছাত্রীদের আহ্বান জানাই। আমরা মনে করি সম্মিলিতভাবে আমরা যদি কাজ করতে পারি তাহলে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে সবদিক থেকে বিশ্বমানের করা সম্ভব। আগামীতে এটিই আমাদের প্রত্যয়। আর অবকাঠামো দিক থেকে আমাদের টুইন ক্যাম্পাস করার একটি স্বপ্ন আছে। আমরা সেই স্বপ্ন দেখে চলেছি। আশা করি সেটিও বাস্তবায়িত হবে।’
এসজি