ডাইনিংয়ে দাম বাড়লেও বাড়েনি খাবারের মান
এক কেজি মুরগির মাংস করা হয় ২০-২৫ পিস। আর মাছের ক্ষেত্রে যত ছোট পিস করা যায়। ভাতের সঙ্গে এক টুকরো মাছ বা মাংস তাতেই বিল আসে ৪০-৪৫ টাকা। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের ডাইনিংগুলোর খাবারের চিত্র এটি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে সঙ্গে খাবারের দাম বাড়লেও বাড়েনি খাবারের মান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থী মশিউর রহমান(ছদ্মনাম)।সকালে ক্লাস না থাকলে ঘুম থেকে ওঠেন দেড়িতে,যাতে সকাল ও দুপুরের খাবার একবারেই সেরে নেওয়া যায়।সকালে ক্লাস থাকলে ক্লাস শেষে দুপুর ১২ টায় সকাল ও দুপুরের খাবার একবারেই সেরে ফেলেন। শুধু মশিউর নয়৷ মশিউরের মতো অধিকাংশ শিক্ষার্থীর রুটিন এটি৷ খাবারের ব্যয়ভার বহন করতে না পেরে তারা এই রুটিন অনুসরণ করছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা যা খান তার দামের খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এক টুকরো মাছ বা মুরগির মাংস এবং ভর্তা দিয়ে এক প্লেট ভাত খেতে সর্বনিম্ন খরচ হয় ৪৮ টাকা। একটি ডিম ও ভর্তা দিয়ে খেতে খরচ পড়ে ৩৮ টাকা। আলাদা হিসাব করলে ভাতের দাম বর্তমানে ৮ টাকা (প্রতি প্লেট), সবজির দাম ২০ টাকা, মাছ ৩০ টাকা, মুরগি ৩০ টাকা। যেখানে ২০২০ সালে প্রতি প্লেট ভাত ছিল ৬ টাকা, ডিম ১৫ টাকা, প্রতি পিস মাংস ২৫ টাকা এবং প্রতি পিস মাছের দাম ছিল ২৫ টাকা।খাবারের দাম বাড়লেও বাড়েনি মান।খাবারের মান আগে যেমন ছিল এখনও তেমন ই আছে বলে দাবি করেছেন শিক্ষার্থীরা।
ডাইনিংয়ের এই খাবার দিয়ে শিক্ষার্থীদের পুষ্টিচাহিদা না মিটলেও অনেকটা বাধ্য হয়েই তারা এই খাবার খাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রুবেল(ছদ্মনাম) বলেন, এই খাবারে আমার দৈহিক চাহিদা পূরণ না হলেও এটি খাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। কারণ আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। আমার মাসে ৪ হাজার টাকার মধ্যে আমার চলতে হয়।পর্যাপ্ত আমিষসমৃদ্ধ খাবার খেতে চাইলে এক বেলায় সর্বনিম্ন ৭০ টাকা খরচ করতে হয়।যেটি বহন করা আমার পক্ষে অসম্ভব।
যারা সকালে নাশতা করেন, তাদের খাদ্যতালিকায় থাকে সাধারণত সবজি ও রুটি বা পরোটা। খুব কম শিক্ষার্থী দৈনিক সকালের নাশতার সঙ্গে ডিম খেতে পান। দুপুর ও রাতের খাবারের তালিকায় থাকে সাধারণত ভাত, মাছ, মুরগির মাংস (ফার্মের),পাতলা ডাল। বিকালের নাশতা বলতে সাধারণত এক-দুই পিস বিস্কুট বা পাউরুটি, কলা বা চটপটি। এসব নিয়মিত খেতে পান এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা হাতেগোনা। এবার দেখা যাক এই খাবারে কতটুকু শক্তি আছে।
পুষ্টিবিদদের মতে, প্রতি ৩০ গ্রামের একটি রুটিতে থাকে ৭০ থেকে ৭৫ ক্যালরি, একটি ডিমে ৯০ ক্যালরি, ১০০ গ্রাম মিক্সড সবজিতে ৫০ ক্যালরি, ৬০ গ্রাম ভাতে ৭৫ থেকে ৮০ ক্যালরি, ৩০ গ্রাম মাছে ৪০ ক্যালরি, ৩০ গ্রাম মুরগিতে ৪০ থেকে ৬০ ক্যালরি, ৩০ গ্রাম ডালে ১০০ ক্যালরি।
গবেষণা বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের শিক্ষার্থীরা দৈনিক যে খাবার খান তাতে পুষ্টির পরিমাণ গড়ে ১ হাজার ৮২১ কিলোক্যালরি। অথচ পুষ্টিবিজ্ঞানীরা বলছেন, একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর দিনে ২ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার কিলোক্যালরি গ্রহণ করা উচিত।
একজন সাধারণ মানুষের প্রয়োজনীয় ও পরিমাণমতো ছয়টি উপাদানযুক্ত খাদ্য গ্রহণ করতে হয়, যা পুষ্টিচাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধক্ষমতাও বাড়ায়। আমিষ, শর্করা, স্নেহ পদার্থ, খনিজ লবণ, ভিটামিন ও পানি গ্রহণ করলে দেহের ক্ষয়পূরণ, বুদ্ধিসাধন, শক্তি উৎপাদনসহ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জিত হয়।
সেজন্য একজন পূর্ণবয়স্ক শিক্ষার্থীর দৈনিক সুষম খাদ্য গ্রহণ করতে হয় সাধারণত ১ হাজার ৩০০ গ্রাম। সেটা এমন হতে পারে : ভাত ২৫০ গ্রাম, আলু ভাজি ১০০ গ্রাম, ছোট মাছ ৮০ গ্রাম, শাকসবজি ২৫০ গ্রাম, মৌসুমি ফল ২৫০ গ্রাম, মাংস ৫০ গ্রাম, চিনি-গুড় ২০ গ্রাম, দুধ ৩০০ গ্রাম। সেখানে হলের খাবারের তালিকায় থাকে ছোট্ট এক টুকরো মুরগি বা মাছ।
হলের আবাসিক শিক্ষার্থী হাসান মাহমুদ(ছদ্মনাম) জানান, পর্যাপ্ত সুষম খাদ্য খেতে হলে আমাদের দৈনিক সর্বনিম্ন ২৫০ টাকার খাবার গ্রহণ করতে হবে, যেটি হলের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর পক্ষে প্রায় অসম্ভব। কারণ এখানে যারা পড়াশোনা করে সবাই মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান।
জয়ন্ত সাহা নামের আরেক শিক্ষার্থী জানান,আমরা যে ধরণের খাবারগুলো গ্রহণ করছি সেটি আমাদের শরীরে মারাত্বক প্রভাব ফেলছে। এটি আমরা এখন বুঝতে না পারলেও বয়স কিছুটা বাড়ার সাথে সাথে এর প্রভাব আমাদের শরীরের উপর পড়বে।
বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে ৪টি আবাসিক হলেই ডাইনিং চালু আছে। ডাইনিংয়ের পাশাপাশি রয়েছে একটি ক্যাফেটেরিয়া। ক্যাফেটেরিয়া খাবার দাম আরও উর্দ্ধমুখী। বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্নিবীণা হল, দোলনচাঁপা হল, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল মিলিয়ে আবাসিক শিক্ষার্থী প্রায় আড়াই হাজার। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের মেসগুলোতে থাকের অনেক শিক্ষার্থী। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়া কিংবা হলের ডাইনিংয়ে খাবারের ওপর নির্ভরশীল।
ডাইনিং ও ক্যাফেটেরিয়া ঘুরে দেখা গেছে, ছোট এক টুকরো মাছ বা মাংসের সাথে পাতলা ডাল দিয়ে খাবার গ্রহণ করছেন অধিকাংশ শিক্ষার্থী।যে ভাত পরিবেশন করা হচ্ছে সেটিও মোটা চালের। ডালের যে পাত্র থাকে, তাতে ডালের পরিমাণ সামান্যই।
জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ডাইনিং মালিক জানান, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে আমাদের কোনো ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে না। দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার ফলে ডাইনিং চালাতে আমাদেরও হিমশিম খেতে হচ্ছে। প্রশাসন থেকে কিছু ভর্তুকি পেলে আমরা খাবারের মান কিছুটা উন্নত করতে পারতাম।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কাছে খাবারে ভর্তুকির দাবি জানিয়ে বঙ্গমাতা হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ইশরাত বলেন, দেশে দ্রব্যমূল্য লাগামহীন গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে আমাদের ডাইনিংয়ের খাবারের দামও বেড়েছে।বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিত ভর্তুকি দিয়ে খাবারের মান ঠিক রাখা।
বঙ্গবন্ধু হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ইমরান বলেন, আমার পরিবারের অবস্থা নুন আনতে পান্তা ফুরায়। কিছুদিন আগেও তিন হাজার টাকায় মাস চলে যেত। আর এখন একবেলা না খেয়েও চার হাজারে মাস পার হচ্ছে না। এখন সকাল-দুপুর মিলিয়ে এক বেলা খাচ্ছি। তবুও টাকা বেশি লাগছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী জানান, ভর্তুকি না থাকায় ডাইনিংয়ে খুবই নিম্নমানের খাবার উচ্চমূল্যে খেতে হয়। এতে টাকাও খরচ হয় পুষ্টিকর খাবারও পাই না। প্রশাসনের উচিৎ হলে খাবারের ভর্তুকির ব্যাপারে নজর দেওয়া।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অগ্নিবীণা হলের প্রভোস্ট কল্যাণাংশু নাহা হলের খাবারের পুষ্টিমান ঠিক আছে দাবি করে বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে খাদ্যের কোনো ভর্তুকি নেই। হলের দায়িত্ব হচ্ছে খাবারের ব্যবস্থা করা এবং দাম ঠিক রাখা। বাইরের তুলনায় আমাদের এখানে কম মূল্যে খাবার সরবরাহ করা হয়৷ কারো যদি অর্থনৈতিক সংকট থাকে তাহলে হয়তো খাদ্যের যোগানের ঘাটতি হতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার কৃষিবিদ ড.হুমায়ুন কবীর বলেন, ডাইনিংয়ে ভর্তুকি নেই এই কথাটি ঠিক না। বাবুর্চির বেতন,রান্নার আসবাব পত্র, প্লেট, গ্লাস এগুলোর ব্যবস্থাপনা করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের তরফ থেকে।যদি ভর্তুকি না থাকতো তাহলে এই খাবার আরও বেশি দামে খেতে হতো। খাদ্যের পুষ্টিমান নিশ্চিতের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ডাইনিং ব্যবস্থাপনার যারা আছেন তারা এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন।
এএজেড