৪২ বছরের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
দেশের স্বাধীনতার পর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে চালু হয়েছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। এখন তার অনেক অর্জন। মোট বিভাগ আছে ৩৪টি। আর ছাত্রছাত্রী আছেন সেখানে ১৩ হাজার। বাংলাদেশ তো বটেই, সারা বিশ্বেই নাম ছড়িয়ে যাচ্ছে তার। লিখেছেন রুমি নোমান
যাত্রা হলো শুরু : বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উচ্চশিক্ষার শুরু করতে চাইলেন সরকার। সেখানে ইসলামী শিক্ষা ও গবেষণার প্রসারের চিন্তাটিই ছিল প্রধান। সেজন্য ১৯৭৬ সালের ১ ডিসেম্বর সরকার একটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করলেন। পরের বছরের শুরুর দিকে সৌদী আররের মক্কায় হলো ‘প্রথম মুসলিম শিক্ষা সম্মেলন’। তাতে আমন্ত্রিত হয়ে গেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান। তিনি প্রতিটি মুসলমান দেশে একটি করে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করলেন। গ্রহণ করা হলো। ফলে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও একটি আন্তর্জাতিক মানের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হলো। সেজন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার ভিসি ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান ড. এম এ বারীর নেতৃত্বে কমিটি করা হলো। তারা অনেক কাজ করে একটি প্রতিবেদন জমা দিলেন। সেটি নিয়ে ১৯৭৯ সালের ২২ নবেম্বর সরকার কুষ্টিয়ার শান্তিডাঙ্গা-দুলালপুরে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করলেন। নানা সংকট পেরিয়ে আস্তে, আস্তে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে তৈরি হয়ে গেল ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর ১৯৮৫ সালে লেখাপড়া শুরু হলো এখানে।
প্রথমের গল্প : ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ভিসি হিসেবে কাজ করেছেন অধ্যাপক ড. এএনএম মমতাজ উদ্দীন। প্রথম শিক্ষাবর্ষ ছিল ১৯৮৫-’৮৬। প্রথম দুটি অনুষদের একটি ছিল থিওলজি অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ। এখানে প্রথম দুটি বিভাগ ছিল আল কুরআন-ওয়া উলুম কুরআন ও উলুমত তাওহীদ ওয়াদ্ দাওয়াহ। অন্য অনুষদটি ছিল মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান। এখানেও দুটি বিভাগ ছিল হিসাববিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা। প্রথম শিক্ষাবষে ভতি হয়েছিলেন প্রায় ৩শ ছাত্র, ছাত্রী।
এখন আছে : একটি বিরাট বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে তৈরি হয়ে গিয়েছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। মোট অনুষদ আছে আটটি। সেগুলোর অধীনে আছে মোট ৩৪টি বিভাগ। ইনিস্টিটিউট আছে একটি। সবগুলো বিভাগের অধীনে মোট ১৩ হাজার শিক্ষার্থী, ৪শ ৫ জন অধ্যাপক, অধ্যাপিকা আছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট কর্মকর্তার সংখ্যা ৩শ ২০ জন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সাহায্যকারী কর্মচারী আছেন ১শ ৮১ জন। সাধারণ কর্মচারী আছেন এই ক্যাম্পাসে মোট ৩শ জন। তাদের সবার মাথার ওপরে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, নামকরা শিক্ষাবিদ ও ক্রীড়া সংগঠক ড. শেখ আব্দুস সালাম। তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩ তম ভিসি।
এটি হলো : বাংলাদেশের ষষ্ঠ বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়। এখন এর বয়স ৪২ বছর। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হলো ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।
এক পলকে : মোট ১শ ৭৫ একরের বিরাট এক বিশ্ববিদ্যালয় এটি। একটি পূণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে যা কিছু আছে, তার সবই আছে এখানে। আছে এখন দুটি প্রশাসনিক ভবন, ছয়টি অ্যাকাডেমিক ভবন, পাঁচটি ছাত্র হল, তিনটি ছাত্রী হল, একটি অত্যাধুনিক মিলনায়তন, ছাত্র-শিক্ষক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র (টিএসসিসি), ক্যাফেটেরিয়া, গ্রন্থাগার, উপাচার্যের বাসভবন, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আলাদা আবাসিক ভবন, আধুনিক একটি ব্যায়ামাগার, দেশের তৃতীয় বৃহত্তম মসজিদ, ভাষা শহীদদের স্মরণে গড়া ‘শহীদ মিনার’, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার স্মৃতিস্মারক ‘মুক্ত বাংলা’, ‘স্মৃতিসৌধ’, বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিস্মারক "মৃত্যুঞ্জয়ী মুজিব’, বিশ্ববিদ্যালয় ডাকঘর, বাংলাদেশ পুলিশের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থানা, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ‘মফিজ লেক’ ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ‘বোটানিক্যাল গার্ডেন’। এখন তো ৫শ ৩৭ কোটি টাকার বিরাট প্রকল্পের উন্নয়ন কাজ চলছে এখানে। তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের চেহারা পুরো পাল্টে যাবে।
লাইব্রেরির গল্প : ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারটি ডিজিটাল। তাতে পড়ালেখার জন্য বই, পত্র হাতের কাছেই পাচ্ছেন ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকরা। সেমিস্টার নিয়মে লেখাপড়া এবং অধ্যাপকদের মনোযোগ দিয়ে পড়ানোর ফলে, ছাত্র, ছাত্রীদের দায়িত্বপূর্ণ আচরণে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো সেশনজট নেই। এই বিষয়ে বলতে গিয়ে আইনের ছাত্রী নিশাত নওরীন জানালেন, ‘এখানে ভর্তি হওয়ার আগে সেশনজটের ভয়াবহতার কথা শুনেছিলাম। তারপরও সাহস করে ভালো বিষয়ে ভর্তি হয়ে গেলাম। তাতে দেখলাম সেশনজট নেই।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন জানিয়েছেন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলা হবে। সেজন্য পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কে ইন্টারনেট সেবার অধীনে নিয়ে আসা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন নানা দেশের মোট ৪০ জন ছাত্র, ছাত্রী পড়ালেখা করছেন। নানা দেশের কয়েকজন শিক্ষকও আছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে।
আছে নানা অসুবিধা : ৪২ বছর হয়ে গেলেও বিশ্ববিদ্যালয়টিতে কিছু অপূর্ণতা আছে। সেগুলোর সমাধান আজো করা যায়নি। এই বিষয়ে বলেছেন পিয়াস পাণ্ডে নামের একজন ছাত্র, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার পরিবেশ ও ক্ষেত্রটি সংকীণ আছে। তাছাড়াও একটি পুর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে একে আজো গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। ছাত্র, ছাত্রীরা ২৫ কিলোমিটারের দূরের পথ পাড়ি দিয়ে লেখাপড়া করতে আসছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র, ছাত্রীদের রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম ছাত্র সংসদ চালু করা হয়নি।
উপাচার্য বলেছেন : ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ আব্দুস সালাম বলেছেন, ‘আমার মূল পরিকল্পনা হলো এই বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি পূর্ণাঙ্গ অ্যাকাডেমিক বিশ্ববিদ্যালয় করে তুলব। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণার প্রয়োজনীয় উন্নত পরিবেশ তৈরী করতে কাজ করছি। এক্ষেত্রে আর্থিক সন্নিবেশ সুনিশ্চিত করব। তবে আমার একার পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে সার্বিক বিষয়গুলো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি মানুষকে সহযোগিতা করতে হবে। ছাত্র, ছাত্রীদের দীঘদিনের দাবী ছাত্র সংসদ নির্বাচন। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এটি তাদের ন্যায্য অধিকার। তবে দেশের ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অসুবিধার কারণে সেটি করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও সংশ্লিষ্ট সবার সাথে কথা বলে পদক্ষেপ গ্রহণের চেষ্টা করব। আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি আধুনিক ও সম্পূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ব্যাপকভাবে কাজ করছি।’
১৮-১-২০২২।