পুরোপুরি বদলে যাবে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক বা বিশ্ববিদ্যালয় গেট পেরুলেই চমকে যাবেন। ভেতরে প্রবেশ করা মাত্রই চোখে পড়বে অনেকগুলো সুন্দর স্থাপনা। যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের রুচি ও মননের প্রকাশ এগুলো। আছে-বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল, সততা ফোয়ারা, মুক্ত বাংলা স্থাপনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতিসৌধটিও অন্যরকম। আগামীতে লেক ও আশপাশের এলাকা এবং শিক্ষকদের নিবাচন করা বিভিন্ন প্রয়োজনীয় স্থান নয়নাভিরাম আকার নিতে যাচ্ছে। তাতে বাইরের লোকেরাও বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ফিরে যেতে চাইবেন না।
এর মধ্যেই আমরা ছাত্র, ছাত্রীরা বলতে শুরু করেছি-আমাদের ১শ ৭৫ একরের ক্যাম্পাসের সৌন্দয ফুটে আছে এসবে। আরো একটু ভেতরে গেলেই বিরাট কমযজ্ঞ থমকে দেবে সবাইকে। তাতে মন খারাপ করার কোনো কারণ নেই, উল্টো খুশি এই ভুবনের মানুষরা। কেননা, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলটির সেরা বিশ্ববিদ্যালয়টি ব্যস্ত হয়ে উঠেছে দেশের সেরা হতে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. রশিদ আশকারীর নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পরিকল্পনাটি অনেক খেটে, বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের সাহায্য নিয়ে তৈরি করেছে। ২০১৭ সালের এপ্রিলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)তে তারা চাহিদাপত্র দাখিল করেছেন। আমরা জানি, মোট ৪ শ ৫৯ কোটি টাকার চাহিদাপত্র জমা দেওয়া হয়েছিল। অনেক যাছাই, বাছাই ও মাঠ জরিপের পর প্রকল্পের প্রয়োজনীয় অথের পরিমাণ বেড়েছে।
অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)’র ২৭তম সভায়, ২০১৮ সালের ২৫ জুন অনুমোদনের মাধ্যমে ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়নের স্বপ্নটি বাড়তে শুরু করে। অধ্যাপকরা বলেছেন, একনেকে আলোচনার ছয় নম্বর এজেন্ডা হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় মেগা প্রকল্পটি উত্থাপিত হয়েছিল। চাহিদা পর্যালোচনা শেষে অর্থনীতিবিদরা ৪শ ৯৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকার প্রস্তাব করেন। চূড়ান্তভাবে প্রকল্পের টাকা আরো বাড়িয়ে ৫শ ৩৭ কোটি ৭ লক্ষ টাকার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এরপর থেকে পুরো টাকা ভালোভাবে খরচের জন্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের কাজে সবাই নেমেছেন। কাজ চলছে। তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো চেহারাই পাল্টে যাবে। এমনই হবার স্বপ্ন বোনা শুরু করেছিল, বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করে বদলে যাচ্ছে এই ক্যাম্পাস।
কী হবে আমাদের ক্যাম্পাসের চেহারা; বিবরণের পর আপনার চোখও কপালে উঠবে। মোট নয়টি ১০ তলা ভবন বানানো হচ্ছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। মোট ১৯টি ভবন আরো সম্প্রসারিত ও বড় আকারে রূপ লাভ করবে। হাজার, হাজার ছাত্র-ছাত্রী; শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জীবন চিরকালের জন্য বদলে যাবে। এবার বলি গোপন কথা, ছাত্রদের জন্য দুটি ও ছাত্রীদের জন্য দুটি ১০ তলা আবাসিক হল তৈরি হচ্ছে। একটি অ্যাকাডেমিক ভবন হচ্ছে। অধ্যাপক ও অধ্যাপিকাদের জন্য এবং কর্মকর্তাদের জন্য একটি ভবন করা হচ্ছে। কর্মচারীদের জন্য আলাদা একটি ভবন হচ্ছে। শেখ রাসেলের নামে যে ভবন হচ্ছে, তাতে দ্বিতীয় ব্লক ও নতুন একটি প্রশাসনিক ভবন হচ্ছে।
যে ভবনগুলো বেড়ে উঠছে আরো সম্প্রসারিত ও বড় আকারের সেগুলো হলো, দ্বিতীয় প্রশাসন ভবন, ‘বিষাদ সিন্ধু’র মীর মোশাররফ হোসেন একাডেমিক ভবন, ব্যবসা প্রশাসন অনুষদ ভবন, রবীন্দ্র-নজরুল দ্বিতীয় কলা অনুষদ ভবন, দ্বিতীয় ডরমেটরি, ড. ওয়াজেদ মিয়া দ্বিতীয় বিজ্ঞান ভবন, বিশ্ববিদ্যালয় মেডিক্যাল সেন্টার, প্রভোস্ট কোয়ার্টার, টিএসসি। এর মধ্যে রয়েছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজের পাঁচতলা একটি নতুন ভবন তৈরি ও পুরোনো ভবনটি সম্প্রসারণ। তাছাড়াও শিক্ষক-কর্মকর্তাদের জন্য আরেকটি নির্মানার্ধীন ভবন ভালোভাবে করার পরিকল্পনা আছে। আমাদের প্রকৌশল বিভাগ জানিয়েছে, ৪ থেকে ৫ মাসের মধ্যে সব ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ কাজ সম্পন্ন হবে।
প্রশাসন থেকে আমাদের জানানো হয়েছে, অধ্যাপকরা বলেছেন, নয়টি ১০ তলা ভবনের ৮টির চুক্তিপত্র হয়েছে। ছাত্র হল ২’র কাজে কিছু জটিলতা আছে। তাতে পুরো চুক্তিপত্র সম্পন্ন হতে সময় লাগছে। কোনো বিশেষ ব্যক্তির নামে এই ভবনের নামকরণ করা উচিত বলে আমরা মনে করি। এই পুরো অবকাঠামোতে কী লাভ হবে, সেটি সাদা চোখে যেকোনো মানুষ বুঝে ফেলবেন। তারপরও আমাদের খবরে প্রকাশ, ১০ তলা আবাসিক হলগুলোর কাজ শেষ হওয়ার পর থাকতে শুরু করলে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৫ ভাগ ছাত্র, ছাত্রীর থাকার সুবিধা তৈরি হবে।
আমাদের ১০ তলা অ্যাকাডেমিক ভবনটি তৈরি হবার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণী কক্ষগুলোর সংকট দূর হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবিত বিভাগগুলোও চালু করা সম্ভব হবে। প্রশাসন ভবনটি তৈরি হবার পর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় অফিসগুলোর উন্নত ও মানসম্পন্ন ব্যবস্থা হবে। ছাত্র, ছাত্রী ও শিক্ষক; কর্মকর্তা, কর্মচারীরা উন্নত মানের সেবা ও সুবিধা লাভ করতে পারবেন। প্রশাসনিক স্থান সংকট দূর হয়ে যাবে।
কেবল অবকাঠামোগত উন্নতিতেই থেমে থাকেননি আমাদের শিক্ষকরা। তারা আমাদের কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান গবেষণাগারের জন্য উন্নত ও মানসম্পন্ন যন্ত্রপাতি কেনার টাকাও নিয়ে এসেছেন একনেক থেকে। তারা আমাদের জন্য কম্পিউটার ল্যাবরেটরিও তৈরি করবেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন। তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা খাতের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটবে বলে আমরা নিশ্চিত।
এই বিরাট প্রকল্পের অধীনে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকগুলো গভীর নলকূপ বসানো হবে। তৃষ্ণার্ত যেকোনো মানুষ সুপেয় জল পান করতে পারবেন। এছাড়াও ভবিষ্যতের বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য থাকছে ‘রেইন ওয়াটার হারভেষ্ট প্ল্যান্ট’। তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা ভবনে বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহ করা সম্ভব হবে। আমাদের ক্যাম্পাসের লেকে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকছে। তার বাদেও পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের জলজনিত সব ধরণের সংকটের সুরাহা করা হবে বলে জানানো হয়েছে।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছে পুরোপুরি নিরাপদ ৫শ কেভিএ’র দুটি বিদ্যুত সাব-স্টেশন। পুরো ক্যাম্পাসকে আলোয় আলোকিত করা যাবে বলে জানানো হয়েছে প্রকৌশল শাখা হতে। জানিয়েছেন, বাংলাদেশের পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের সঙ্গে তারা চুক্তি করেছেন। এই কাজে ছয় সদস্যের একটি কমিটি কাজ করছে। আর সব ভবনের কাজ শেষ হলে ভবনগুলোর ওপরে সোলার প্যানেল বা সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা থাকবে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় তার চিরকালীন নিরাপদ, পরিবেশবান্ধব ও উন্নত গবেষনার রূপ লাভ করবে। তাতে জেনারেটরের খরচগুলো বাঁচবে। সেই টাকা অন্যখাতে ব্যবহার করা যাবে। অর্থের অপচয় না করার সংস্কৃতি শক্তিশালী হবে।
ছাত্র, ছাত্রীদের শারিরীকভাবে ভালো রাখতে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ব্যয়ামাগারের উন্নয়ন করা হচ্ছে। নতুন ব্যায়াম উপকরণ আসছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ভূমি উন্নয়ন প্রকল্প’র অধীনে একনেকের টাকায় ক্যাম্পাসের নীচু ও বিভিন্ন নীচু ভবনের আশপাশের এলাকাতে ভালো মানের মাটি ফেলে সেগুলোতে ভরাট করে দীর্ঘস্থায়ী আকার দেওয়া হচ্ছে। এজন্য টেন্ডার কাজ চলছে।
তবে শিক্ষকরা দু:শ্চিন্তায় আছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের খবর বিভিন্ন কাগজে ছাপানোর সূত্রে তাদের সহযোগী হিসেবে আমাদের কপালেও চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। কেননা, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ভালোভাবে কাজ করতে না পারলে, কোনো কাজ ফেলে রাখলে সেই টাকাগুলো ফেরত চলে যাবে। আবার নিয়ে আসতে শিক্ষকদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হবে। এই অনিশ্চিত যাত্রা কে চায়? আমাদের ব্যাথা আছে-গেল অর্থবছরে বরাদ্দ পাওয়া বেশ টাকা ফেরত গিয়েছে, আমরা কষ্ট পেয়েছি। সে বোঝা এখনো বইতে হচ্ছে। গাধার খাটুনি আরো বাড়বে টেন্ডার ভালোভাবে করতে না পারলে, কাজের গুণগত মান নিশ্চিত না হলে।
সব নিয়ে কথা বলেছি আমি-ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী মুন্সি মোহাম্মদ তারেকের সঙ্গে। তিনি আমাকে জানিয়েছেন, ‘আমরা পুরোপুরি চেষ্টা করছি যাতে সময়ের মধ্যে সব কাজ শেষ করতে পারি। তবে আরো কিছু সময় লাগবে বলে আমার ধারণা। সেজন্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেওয়া হবে। আমিও আপনাদের মতো জানি-মহা প্রকল্পের কাজ শেষে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় বদলে যাবে।’
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালাম জানিয়েছেন, ‘মহা পরিকল্পনাটির কাজ অনেক আগে শুরু হয়েছে। আমার শুরুতে এই কাজটি মুখ থুবড়ে পড়ে ছিল। চ্যালেঞ্জ নিয়ে আমি কাজটি শুরু করেছি। এই কাজ শেষ হলে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের আবাসন সমস্যা মিটে যাবে। পঠন-পাঠনের সেরা ব্যবস্থা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়ন ব্যাপকভাবে হবে। যদি টাকা বাঁচে, সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে আমি আইনে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের কাজে লাগানো লাগানোর চেষ্টা করব।’