জবির কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার যেন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংসার!
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারকে নিজের বাড়িঘরের মতো ব্যবহার করছেন দপ্তরটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। গ্রন্থাগারকে পারিবারিক রান্নাঘরে পরিণত করে রেখেছেন তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অবৈধ ইলেকট্রিক চুলায় চলে রান্না। ঘুমানোর জন্য রয়েছে কাঁথা-বালিশের ব্যবস্থাও। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের 'লাঞ্চ' শেষ হয় বিকাল ৩টার পর।
বুধবার (৭ আগস্ট) সরেজমিনে দেখা যায়, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের দক্ষিণ পাশের কক্ষে এক পাশে পর্দা লাগিয়ে আড়ালে বানানো হয়েছে অবৈধ রান্না ঘর। ভেতরে বৈদ্যুতিক চুলার মাধ্যমে করা হয় রান্না-বান্নার কাজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েই অবৈধ বৈদ্যুতিক চুলায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য রান্না করা হয়। এতে বিদ্যুতের অপচয়ের পাশাপাশি নষ্ট হচ্ছে গ্রন্থাগারের পড়াশোনার পরিবেশও। রান্নার কারণে ধোয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় পাশের পড়ার কক্ষ। ভেতরে কী চলছে দেখতে চাইলে সাংবাদিককে বাধা দেন অফিস অ্যাটেন্ডেন্ট সেলিমা খাতুন এবং বুক সর্টার সাদিয়া সামাদ ইভা। তারা জানান, স্যারের অনুমতি ব্যতীত ভেতরে প্রবেশ করা যাবে না।
ভেতরে দেখা যায়, অফিস কক্ষকে পারিবারিক রান্নাঘরে পরিণত করে রাখা হয়েছে। অনেক বড় বড় রাইসকুকার আর প্রেসারকুকার রাখা ভেতরে। যা ব্যবহারে অধিক পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যয় হয়। ভেতরের পরিবেশের ছবি তুলতে চাইলে বাধা প্রদান করেন কর্তব্যরত অফিস অ্যাটেন্ডেন্ট সেলিমা খাতুন এবং বুক সর্টার সাদিয়া সামাদ ইভা। প্রতিবেদকের সঙ্গে অশালীন ব্যবহারও করেন তারা।
পরবর্তীতে গ্রন্থাগারিক মো. এনামুল হকের সঙ্গে দেখা করে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি চাইলে তিনি তা নাকচ করে দেন। তিনি বলেন, 'একমাত্র শিক্ষক ব্যতীত ভেতরে যাওয়ার কোনো অনুমতি নেই। কেউ দেখতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে মিটিং করে তারপর অনুমতি দিতে পারব। সাংবাদিকদের ভেতরে যাওয়ার নিয়ম নেই।'
সাংবাদিকরা তার তথ্য সংগ্রহ করতে যেকোনো জায়গায় যেতে পারেন এবং তথ্য সুরক্ষা আইনে সহায়তার কথা মনে করিয়ে দিলে তিনি আরও ক্ষেপে যান। তিনি বলেন, 'সাংবাদিক হইছে তো কি হইছে? এটা আমার দপ্তর। আমার নিয়মে চলবে।'
দপ্তরে রান্না করার নিয়ম আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আসলে এমন নিয়ম নেই। সবাই সকাল ৮টায় আসে, রাতে যায়। সেজন্যই রান্নার ব্যবস্থা করা হয়েছে।'
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিদুৎ সাশ্রয়ে সপ্তাহে একদিন অনলাইন ক্লাস নিলেও তা তোয়াক্কা না করে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে রান্না ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দেশনা অমান্য করার বিষয়ে জানতে চাইলে উগ্র ভাষায় তিনি ওই সাংবাদিককে বলেন, 'আমার দপ্তর আমার নিয়মে চলবে। অন্য কারোর আইন মানার সময় নেই।'
সরেজমিনে আরও দেখা যায়, কক্ষটির প্রবেশ পথেই টেবিলের উপর কাঁথা-বালিশ রাখা। রিসিপশনে কেন কাঁথা থাকবে সেই প্রশ্নেরও জবাব পাওয়া যায়নি।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মানুযায়ী 'লাঞ্চটাইম' দুপুর ১টা থেকে ২টা পর্যন্ত। তবে এখানে শেষ হয় বিকাল ৩টায়। বিভিন্ন কাজে শিক্ষার্থীরা গেলে লাঞ্চের পর আসার কথা বলা হয়। লাঞ্চের শেষ সময় দুপুর ২টা হলেও এখানে মানা হয় না সেই নিয়ম।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মচারী জানান, গ্রন্থাগারিক এনামুল হকের 'লাঞ্চ' করতে দেরি হয়ে যায়। সেজন্য অন্যদেরও লাঞ্চ ও নামাজ শেষ করতে বিকাল ৩টা পার হয়ে যায়। এনামুল হকের ইচ্ছাতেই এমন অনিয়ম চলছে বলে জানা যায়।
এদিকে, বিকাল ৩টায় গিয়েও গ্রন্থাগারের একাধিক কর্মকর্তার অফিস কক্ষ খালি পাওয়া যায়। বিকাল ৪টা পর্যন্ত অফিসের সময় থাকলেও তার আগেই বের হয়ে যান তারা। প্রায় প্রতিদিনই চলে এমন অনিয়ম।
এ ছাড়াও ই-লাইব্রেরির জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একশটি কম্পিউটার বরাদ্দ দেওয়া থাকলেও সেগুলোর বাস্তবিক ব্যবহার দেখা যায়নি।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্রে জানা যায়, লাইব্রেরির জন্য ববরাদ্দ দেওয়া কম্পিউটার ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করছে গ্রন্থাগারের কর্মকর্তারা। গ্রন্থাগারিক এনামুল হক নিজেও বাসায় নিয়ে রেখেছেন গ্রন্থাগারের একাধিক ল্যাপটপ।
এদিকে, গ্রন্থাগারে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও প্রতিনিয়ত অশালীন আচরণ করেন সেখানে কর্মরত কর্মচারীরা। অফিস অ্যাটেন্ডেন্ট সেলিমা খাতুন এবং বুক সর্টার সাদিয়া সামাদ ইভার বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে উগ্র ব্যবহার ও ধাক্কা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
উল্লেখ্য, এর আগেও গ্রন্থাগারিক মো. এনামুল হকের বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছে। ওই দপ্তরের এক কর্মচারীর সঙ্গে তার বিশেষ সম্পর্কের গুঞ্জন রয়েছে চারদিকে। ওই নারী কর্মচারী বিশ্ববিদ্যালয়ের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়ায় উপস্থিত থেকে হাজিরা দিয়ে বেতন তোলার নিয়ম থাকলেও এনামুল হকের সহযোগিতায় মানা হয়নি এই নিয়ম। তিনি ওই নারীকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে উপস্থিত না থেকেও হাজিরার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। অনুপস্থিত থাকা সত্ত্বেও রাবেয়া নামের ওই নারী কর্মচারীকে বেতন দিয়েছেন গ্রন্থাগারিক মো. এনামুল হক। এ ছাড়াও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া রাবেয়া নামের ওই নারী কর্মচারীকে নিয়মবহির্ভূতভাবে গ্রন্থাগারের চাবিও হস্তান্তর করার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।
এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইমদাদুল হক বলেন, লাইব্রেরির মতো একটি জায়গায় এমন অনৈতিক কর্মকাণ্ড দুঃখজনক। তদন্ত সাপেক্ষে খুব শিগগিরই আমরা এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
এসএন