মানবাধিকার পরিস্থিতি অতীতের তুলনায় নিঃসন্দেহে ভালো
মানবাধিকার পরিস্থিতি সার্বিকভাবে বলাটা কিন্তু কঠিন ব্যাপার। এখানে আমাকে মানবাধিকার পরিস্থিতিকে দুটো ভাগে ভাগ করে নিতে হবে। একটি হচ্ছে রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার, অপরটি হচ্ছে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, চুক্তি বা সামাজিক অধিকার। এই ক্ষেত্রে মানবাধিকার পরিস্থিতি কী রকম।
একটি কথা বোধহয় সব তর্কের অতীত। সেটি হচ্ছে যে, বাংলাদেশ নানাভাবে অর্থনৈতিক দিক থেকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইন্ডিকেটরে বিশ্বের অনেক দেশকে পেছনে ফেলে ও দ্রুততম গতিতে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে চলছে। সেই দিক থেকে যদি চারপাশে তাকাই আমরা কিন্তু স্বাভাবিক চোখেও দেখতে পাব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটছে দেশে। নাগরিকরা আগের তুলনায় অনেক ভালো আছেন দেশে— এটা কিন্তু দৃশ্যমান এখন।
তবে আমরা জানি যে, আমাদের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের ক্ষেত্রে আমরা হয়ত যতটা সফলতা অর্জন করতে চেয়েছিলাম বা প্রত্যাশা করেছিলাম হয়ত সেখানে কিছুটা ঘাটতি থাকতে পারে। বিশেষ করে আমার মনে হয়— সাধারণ মানুষ তা অনেক সময় প্রশাসন কর্তৃক হয়রানির শিকার হয়। যে প্রশাসন হতে পারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অনেক সময় হতে পারে আমাদের বেসামরিক প্রশাসন সিভিলাইজেশনের। সেটা আমাদের জেলা পর্যায়, উপজেলা পর্যায় বা গ্রাম পর্যায়ে হয়ে থাকে। আমরা কিন্তু যে সত্যটা বাংলাদেশের জন্মের সময় জেনেছি, যে সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তা হচ্ছে জনগণের সেবক। এই সেবক কথাটার যথার্থতার প্রমাণ সব সময় পাই— এমনটা নয়। আমাদের এই ক্ষেত্রে তারা যদি সত্যিকার অর্থেই জনগণের সেবক হিসেবে তাদের ভূমিকা পালন করতে পারতেন তাহলে হয়ত নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার ক্ষেত্রেও আমরা আরও বেশি অগ্রগতি সাধন করতে সক্ষম হতাম। তবে গোটা বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় নিঃসন্দেহে অনেকটা ভালো।
বিশ্বব্যাপী কিন্তু মানবাধিকারে যে ঝড় অতীতে লক্ষ্য করেছি সে ঝড়টা কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব তাদের মেরু হিসেবে পালন করতে চায়। বিশ্ব রাজনীতিতে এ কারণে কিন্তু ঝড়টার স্থিতি থেমে গেছে কিন্তু মানবাধিকার আন্দোলনটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আজকে আফগানিস্থানে যে অবস্থা, আজকে সিরিয়াতে যে অবস্থা, আজকে ইয়েমেনে যে অবস্থা, আজকে মিয়ানমারের যে অবস্থা সব কিছুর পেছনে খতিয়ে দেখলে দেখা যায়, পেছনের শক্তি তাদের ভেতরে প্রতিযোগিতা। একটি অশুভ প্রতিযোগিতার কারণে এ রাষ্ট্র ব্যাপ্তি জনগণ নিপীড়িত ও নির্যাতিত হচ্ছেন এবং আমার মনে হয় চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। সেই তুলনায় উন্নয়নশীল বিশ্বে আমরা যে আচরণ করেছি, আমরা মনে করি উন্নত বিশ্ব যদি মানবাধিকারের প্রতি সত্যিকার অর্থে অনুগত প্রকাশ করত, শতভাগ মানবাধিকার সুরক্ষায় কাজ করে যেতেন, তাহলে বিশ্ব মানবাধিকার পরিস্থিতি আরও অনেক উন্নতি লাভ করতে সক্ষম হতো। আজকে কিন্তু মানবাধিকার একটা বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে আমাদের এই ক্লাইমেট চেঞ্জ বা পরিবেশে যে পরিবর্তনটি ঘটছে এটার পেছনে দায়ি কিন্তু বিশ্বের উন্নত দেশগুলো। আজকে যদি দেখি যে, বাংলাদেশের অনেক অংশ সমুদ্রের নিচে তলিয়ে যাবে। মালদ্বীপ নামক দেশটি হয়ত ভবিষ্যতে সাগরের নিচে তলিয়ে যাবে। এই সম্ভাবনা দেশটি পেছনে ভূমিকা পালন করেছে আমরা নই, মালদ্বীপের জনগণ নয় এর মূল ভূমিকা পালন করেছে পশ্চিমা রাষ্ট্রসমূহ— যারা তাদের উন্নয়নের জন্য পরিবেশের দিকে কখনোই ভ্রুক্ষেপ করেন নি। এখন এদের ক্ষতিপূরণ আমাদের দিতে হচ্ছে। সেই তুলনায় আমি বলবো যে মানবাধিকার পরিস্থিতি আগের তুলনায় অনেক বেশি তূলনামূলক একটি বিপদের মুখে রয়েছে। মানবাধিকার নিয়ে মানুষ যতটা সজাগ ছিল, পৃথিবীব্যাপী যে জোরদার আন্দোলন ছিল, আন্দোলন অনেক দুর্বল হয়ে গেছে।
আমি বলব যে, আমাদের আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা স্পর্শকাতর বিষয় কিন্তু আমাদের জন্য অতি গুরুত্ব বিষয়ে অবতরণ করেছেন এই প্রশ্নের মাধ্যমে। আমরা জানি আমাদের বাংলাদেশে যারা নিরীহ জনগণ তাদের নিরীহ অর্থে বলব যে তারা কিন্তু সন্ত্রাসী নয়। তাদের হাতে কিন্তু অস্ত্র নিয়ে ঘুরাফেরা করে না। তারা কিন্তু সন্ত্রাসী আক্রমণ করে না। হয়ত তারা হবে নিতান্তই দরিদ্র মানুষ, তাই হয়ত ক’টা শাড়ি বা দ্রব্য আনতেই পারে। পাসপোর্ট ভিসা নেই, আমি কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে সীমান্তের ওপারে চলে যাচ্ছি। এই অপরাধ একজন মানুষ হয়ত করতেই পারে।
আমি নিশ্চিত হয়ে একটা কথা বলতে পারি যে, যখন দুটো রাষ্ট্রের মধ্যে এরকম পরস্পর বর্ডার থাকে, যেখানে ইসরাইল বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উচ্চ দালান আমি করে দেয়নি। সেখানে যদি বর্ডার থাকে উভয় পক্ষ থেকে আনাগোনা হয়ে থাকে এটা হচ্ছে বাস্তবতা। যে মানুষ মানুষের পরস্পরের সাথে কথা বলবে, তারা মিলিত হবে, তারা আত্মীয় সম্পর্ক হবে এমনটি তারা দেখা করতে চাইবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু সেই অপরাধের জন্য আপনি একজন মানুষের জীবন কেড়ে নিতে পারেন না। এটাই আমি বলব বড় মাপের মানবাধিকার লঙ্ঘন। আমার প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্র তাদের কাছ থেকে কিন্তু এরকম আচরণ প্রত্যাশা করি না।
আমার মনে পড়ছে যে, যখন আমি মানবাধিকার কমিশনের দায়িত্বে ছিলাম তখন ১৩ বছরের একটা ছোট মেয়ে ফেলানী। সেই ফেলানীর মৃতদেহ আমরা দেখেছি, কুড়িগ্রামে কাঁটাতারের বেড়ার উপরে কয়েক ঘণ্টা ঝুলে ছিল। এর চেয়ে বড়, অধিকতম, নিষ্ঠুরতম, বেদনাদায়ক আর কোনো ছবি কখনো আপনি খুঁজে পাবেন না। তখনো কিন্তু আমরা দেখেছি যে ভারত কিন্তু ফেলানীর হত্যার ব্যাপারে নির্বিকার থাকতে চেয়েছিল এবং প্রথম অবস্থায় তারা যে তাকে গুলি করেছে সেই বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স জওয়ানকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে তারা কিন্তু প্রস্তুত ছিল না। আমার মনে আছে তখন আমি ভারতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান প্রধান সাবেক বিচারপতি বালাকৃষ্ণ এর কাছে একটি চিঠি লিখেছিলাম এবং আমি সেই চিঠিতে বলেছিলাম আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে যে কেন ভারতে এ আচরণ আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন , মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং এখানে উচিত হবে মানবাধিকার কমিশনকে এগিয়ে এসে বিচারের ব্যবস্থা করা। আমি অনেকটা সন্তুষ্ট হয়েছিলাম যে, আমার চিঠিটা পাবার পরেই বালাকৃষ্ণ সশরীরে পশ্চিমবঙ্গে যান। বিএসএফের সঙ্গে বসেন এবং পরবর্তীতে বিএসএফের জওয়ানের বিরুদ্ধে একটি মামলা রজ্জু হয়। যদিও আমরা বিচারে কাঙ্খিত ফল লাভ করিনি অর্থাৎ যে বিচারটি অনুষ্ঠিত হয়েছে এই পদক্ষেপ টুকু পেয়েছে এই ব্যাপারে কিন্তু আমাদের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে একটি উদ্যোগ নিয়েছিলাম সে উদ্যোগের কারণে এ কাজটি করতে সফল হয়েছিলাম। এ ধরনের সীমান্তবর্তী নির্যাতন হত্যা করা, তাদের প্রাণকেড়ে নেওয়া এটা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটি অপ্রত্যাশিত এবং আমাদের প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্রের কাছ থেকে আমরা কখনোই এরকম আচরণ আশা করি না।
এখানে আমি একটি কথা স্পষ্ট করে বলতে চাই যে, যদি কেউ বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিশ্বাস না করে, যদি কেউ এখন পর্যন্ত আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নামে সম্বোধন করতে দ্বিধা বোধ করে, বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করতে দ্বিধা বোধ করেন, আমার তো মনে হয় সে রকম ব্যক্তির পেশা বা তার কোনো রকম কাজ করার অধিকার এ রাষ্ট্রে থাকা উচিত বলে আমি মনে করি না। আমি বিশ্বাস করি— কোনো স্বাধীনতাই কিন্তু লাইসেন্স নয়, যেমন ইচ্ছে তেমন কিন্তু করতে পারি না।
মানবাধিকার তো আসলে বিশাল একটি ভুবন। সেই ভুবনে কোনো ব্যক্তির একার পক্ষে বা কোনো সংগঠনের একার পক্ষে কিন্তু সব কিছু করা সম্ভব নয়। একটা সমন্বিত প্রচেষ্টার দরকার এবং এই প্রচেষ্টা অব্যাহত এবং এটি চলতে থাকবে। কেননা মানবাধিকারের কিন্তু এমন কোনো লক্ষ্য নেই যে আমি সেই লক্ষ্য পৌঁছে গেছি আর মানবাধিকার আন্দোলন শেষ হয়ে গেল; আর কোনো কিছু প্রয়োজন নেই। ব্যাপারটা কিন্তু এমনটা নয়। ঠিক যেমন আমাদের চাহিদা যেমনটি শেষ নেই, ঠিক তেমনি একটি মানুষের জীবনের যে মানদণ্ড সেই মানদণ্ড উঁচুতে আরও উন্নত করতে পারি এবং যেটা ইংরেজিতে বলা হয় স্কাই ইজ দ্য লিমিট। আকাশ হচ্ছে আমার সেই সীমানা যে আকাশ পর্যন্ত আমাকে যেতে হবে। এখন যদি সেটি হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে আপনি কিন্তু যে মানবাধিকার সর্ব ক্ষেত্রে বিচরণ করছেন তা কিন্তু নয়। আমি একটা ছোট ক্ষেত্রকে নির্বাচন করে নিয়েছি। সেটা হচ্ছে—মানবাধিকার সুরক্ষা, দরিদ্র এবং প্রান্তিক জনগণের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আমাদের দেশে আইনের জ্ঞানসম্পন্ন কিছু যোগ্য মানুষের দরকার বলে আমি মনে করি।
অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান: সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন
আরএ/