তিন বিশিষ্টজনকে পদক
চাঁদের হাটের মতো সংগঠন খুব প্রয়োজন: তথ্যমন্ত্রী
অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ
জাতীয় শিশু কিশোর ও যুবকল্যাণ সংগঠন ‘চাঁদের হাট’ তিন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে ‘দাদুভাই স্মৃতি পদক’ দিয়েছে। চাঁদের হাটের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি প্রয়াত রফিকুল হক দাদুভাইয়ের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এই পদক চালু করেছে সংগঠনটি।
প্রথমবারের মত চালু হওয়া এই পদক দেওয়া হয়েছে তিনটি বিভাগে। এরমধ্যে ছড়াসাহিত্যে পদক পেয়েছেন সাবেক সচিব ও ছড়াকার ফারুক হোসেন, গান রচনায় (গীতিকার) ক্যাটাগরিতে মো. মঞ্জুর উল আলম চৌধুরী এবং সাংবাদিকতায় দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদক সাইফুল আলম।
বৃহস্পতিবার (৩ মার্চ) জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এই তিন বিশিষ্ট ব্যক্তির হাতে পদক তুলে দেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।
পদক প্রদান শেষে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী বলেন, চাঁদের হাট এমন একটি সংগঠন যেটি বাংলাদেশে বহু গুণীজনের জন্ম দিয়েছে। শিশু-কিশোরদের মেধা বিকাশের ক্ষেত্রে, তাদের মননশীলতা বিকাশের ক্ষেত্রে, তাদের সাহিত্যমনস্ক করার ক্ষেত্রে চাঁদের হাট গত কয়েক দশক ধরে যে ভূমিকা রেখেছে সেটি সত্যিই অতুলনীয়। সেজন্য আমি চাঁদের হাটের প্রতিষ্ঠাতা রফিকুল ইসলাম দাদুভাইয়ের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। নিজের ছোটেবেলার কথা স্মরণ করে দিয়ে মন্ত্রী বলেন, আমি যদি আমার জীবনের পেছন ফিরে তাকাই তাহলে আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে, কাগজে লেখালেখি—জীবন গড়ার ক্ষেত্রে ও আজকের পর্যায়ে আসার ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রেখেছে।
তিনি বলেন, আমার কাছে জীবন একটি সংগ্রাম, একটি যুদ্ধ। জীবন সংগ্রামে প্রত্যয়ী হওয়া, জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়া, প্রতিবন্ধকতা উপড়ে ফেলে লক্ষ্যে পৌঁছানো—এগুলো আসলে চাঁদের হাটের মত যেসব শিশু-কিশোর সংগঠন ছিল, তারা যেভাবে শিশু-কিশোরদের গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছিল, এখন দুঃখজনক হলেও সত্য সে সমস্ত সংগঠন আগের মত সক্রিয় নেই। কিন্তু সংগঠন আছে। আমি মনে করি আজকের প্রেক্ষাপটে এ সমস্ত সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা আরও অনেক বেশি। যখন শিশু-কিশোরদের বিপথগামী হওয়ার সুযোগ অনেক বেশি তখন এই ধরনের সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা আগের তুলনায় বেশি। দেখা যাচ্ছে ছেলে ঘরেই থাকছে, ঘরেই খাচ্ছে, ঘরেই ঘুমাচ্ছে, কিন্তু ছেলে যে ভেতরে ভেতরে বিপথগামী হয়ে গেল বাবা-মা খেয়ালই করতে পারলেন না। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে জঙ্গীবাদে জড়িয়ে গেল। বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে মিশতে এক সময় মাদকাসক্ত হয়ে পড়ল।
হাছান মাহমুদ বলেন, যখন কোনো শিশু-কিশোর সৃষ্টিশীল কাজের সঙ্গে লিপ্ত থাকে, তখন তাকে বিপথগামী হওয়া থেকে সৃষ্টিশীল কাজগুলো বাধা দিতে থাকে। এ জন্য আমি মনে করি এ ধরনের সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা আগের তুলনায় অনেক বেশি।
তিনি বলেন, আমি ব্যক্তিভাবে মনে করি শুধুমাত্র বস্তুগত উন্নয়নের মাধ্যমে দেশ গঠন হয় না। তিনি ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার উদাহরণ দিয়ে বলেন, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা অনেক উন্নত। কিন্তু ছেলে মেয়েরা যখন বড় হয় তখন তারা আর বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকে না। সে জন্য উন্নত রাষ্ট্র গঠনের পাশাপাশি একটি মানবিক রাষ্ট্র আমরা চাই। একইসঙ্গে মানুষে মানুষে মমত্ববোধ থাকবে, মানবিকতা থাকবে, দেশাত্ববোধ থাকবে। তাহলেই একটি রাষ্ট্র গঠন হবে। সেই রাষ্ট্র গঠন করতে আমার মধ্যে পরিবর্তন এনে সম্ভব নয়। সেই রাষ্ট্র গঠনের জন্য ধরতে হবে শিশু-কিশোরদের। তাদের মধ্যে মেধা, মূল্যবোধ, দেশাত্ববোধ জাগ্রত করে সেগুলোর সমন্বয় ঘটিয়ে রাষ্ট্র গঠন করা প্রয়োজন, উন্নত জাতি গঠনের জন্য। এ জন্য চাঁদের হাটের মত সংগঠনগুলোর প্রয়োজনীয়তা আবশ্যিক।
তথ্যমন্ত্রী দেশের বড় পত্রিকার সম্পাদকদের অনুরোধ জানিয়ে বলেন, আগের মত পত্রিকাগুলোতে শিশু-কিশোরদের পাতা সপ্তাহে অন্তত একদিন চালু করেন। আজকে রূপচর্চার জন্য দুই পৃষ্ঠা ছাপা হয়। আরও অনেক কিছু দুই পৃষ্ঠা ছাপা হয়। কিন্তু শিশু-কিশোরদের জন্য কোনো পত্রিকায় পাতা দেখি না। আমি মনে করি, শিশু-কিশোরদের জন্য পত্রিকার পাতায় জায়গা ছাড়লে আমরা যে ধরনের বাংলাদেশ চাচ্ছি সেটি নতুন প্রজন্মের কাছ থেকে পাওয়া সম্ভব।
পদকপ্রাপ্ত প্রকৌশলী মো. মঞ্জুর উল আলম চৌধুরী তার প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, আমি চাঁদের হাটের প্রতি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা তার সঙ্গীতের জন্য তিনি পদক পাওয়ার কথা উল্লেখ করে বলেন, বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ, বীরাঙ্গনা আমাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। সে জন্য আমি সরকারি চাকরির পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করি। আমি যখন সৈয়দপুরে দায়িত্বে ছিলাম তখন সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় ‘অদম্য স্বাধীনতা’ নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করি। ১৯৭১ সালে সৈয়দপুর কারখানায় যে গণহত্যা হয়েছিল সেটিকে স্মরণ করে রাখতেই আমি এটি নির্মাণ করি। আমি বাংলাদেশ রেলওয়েতে দুটি কোচে রেলওয়ে জাদুঘর নির্মাণ করেছি।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমি একটি গান লিখেছি। এটি লিখতে পেরেছি বলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করি। এই গান তৈরি করতে তিন বছর সময় লেগেছে। আমি মনে করি এই গানটি কোটি মানুষের কাছে যাওয়া উচিত। কারণ এই গানটিতে বঙ্গবন্ধুকে তুলে এনেছি। তিনি তথ্যমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলেন, এই গানটি যেন প্রচার লাভ করে।
পদকপ্রাপ্ত সাবেক সচিব ও ছড়াকার ফারুক হোসেন বলেন, আমার কাছে এই পদক খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আমি যে দাদু ভাইয়ের নামে পদক পাচ্ছি সাইফুল ভাইয়ের পাশে একসঙ্গে, এটা আমাকে স্মৃতিকাতর করেছে। কারণ আমি যখন ঢাকায় এসে চাঁদের হাটে লেখা শুরু করলাম তখন সাইফুল ভাইয়ের হাত দিয়ে আমার অনেক গল্প ছাপা হয়েছে। আজ দাদু ভাই একেবারেই স্মৃতি। কিন্তু সেদিনের সেইসব স্মৃতির কথা আজ খুব মনে পড়ে। দাদু ভাই মজার মজার সব গল্প করতেন। আমরা শুনতাম। এই পদকের পেছনে রফিকুল হক দাদুভাই যুক্ত। দাদুভাই আমার কাছে একজন আদর্শ।
দ্বিতীয়টি হল চাঁদের হাট। আমি চাঁদপুরে কলেজে পড়ার সময় আমার বন্ধু জাহাঙ্গীরের মাধ্যমে চাঁদের হাটে যুক্ত হয়েছিলাম। জাহাঙ্গীরও গত কোভিডকালে মারা গেছে। এই পদক পাওয়ার পেছনে চাঁদের হাট যুক্ত। এটিও তাৎপর্যপূর্ণ। দাদুভাই সম্পর্কে বলতে হয়, তিনি সব সময় বলতেন, আমি ছড়া লিখি না, ছড়া বানাই। তার নাটক, গানও অনেক জনপ্রিয়তা পায়।
যুগান্তর সম্পাদক সাইফুল আলম বলেন, এই আজকের আমি চাঁদের হাট এর তৈরি। আমাকে যে পদক দিয়ে সম্মানিত করেছে তাতে আমি চাঁদের হাটের প্রতি কৃতজ্ঞ। এই পদক আমি আবার চাঁদের হাট কেই ফিরিয়ে দিতে চাই। এটা আপনাদের।
চাঁদের হাটের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ইয়াহিয়া সোহেলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন চাঁদের হাটের আজীবন সম্মাননাপ্রাপ্ত স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু, পদক অনুষ্ঠানের সমন্বয়ক মুফদি আহমেদ মনা প্রমুখ।
অনুষ্ঠান শুরু হয় জাতীয় সঙ্গীত ও চাঁদের হাটের সাংগঠনিক সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে।
এনএইচবি/আরএ/