অমর একুশে বইমেলা উদ্বোধন
জেলা পর্যায়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা কমেছে, বাড়ানো দরকার: প্রধানমন্ত্রী
জেলায় পর্যায়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা বাড়ানো ও বইমেলা করার তাগিদ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এজন্য প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণও করেছেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেশের প্রতিটি জেলা-মহকুমায় আগে মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। এখন আর সেটা দেখা যাচ্ছে না। সাহিত্যচর্চা কিছুটা কমে গেছে, এটা আরও বাড়ানো দরকার। শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি এই সুযোগটা তৈরি করে দিতে পারে। সাহিত্য চর্চার প্রতি মনোনিবেশ থাকলে অন্য দিকে তরুণ সমাজ ঝুকে পড়বে না।’
অমর একুশে বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মঙ্গলবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) বিকাল ৩টায় গণভবন থেকে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে ৩৮তম বইমেলার উদ্বোধন করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, খাদ্যনিরাপত্তা আমরা করে দিয়েছি। এখন হৃদয়ের খোরাক জোগাতে হবে। এটা সাহিত্য-সংস্কৃতির মাধ্যমে হবে। সংস্কৃতি চর্চার প্রতি আমাদের নজর দিতে হবে। এজন্য মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান জেলায় জেলায় করা উপযুক্ত হবে। এ বিষয়ে প্রশাসনের দায়িত্বে যারা আছেন, তাদের উদ্যোগ নেওয়া দরকার।’
করোনা পরিস্থিতির কারণে দেরিতে হলেও বইমেলা শুরু করতে পারায় প্রধানমন্ত্রী সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। বক্তৃতার শুরুতে তিনি বাংলা একাডেমির প্রয়াত তিন সভাপতি নিজের শিক্ষক অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, শামসুজ্জামান খান, মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীকে স্মরণ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বইমেলা আমাদের প্রাণের মেলা। কোনো কারণে দেরি হলে আমাদের মন খারাপ হয়। প্রযুক্তির ব্যাপক বিকাশে মুদ্রিত বইয়ের বিকল্প আবিষ্কৃত হলেও ছাপা বইয়ের আবেদন কখনও ফুরোবার নয়। এজন্যই অমর একুশে বইমেলা আমাদের প্রাণের মেলা। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং ভাষা আন্দোলনের সত্তর বছরের মাহেন্দ্রক্ষণে অমর একুশে বইমেলা ২০২২ প্রাণপূর্ণ এবং পাঠকপ্রিয় হবে বলে আমরা আশা করি ‘
তিনি বলেন, ‘বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা যেমন জরুরি তেমনি অনুবাদের মাধ্যমে আমাদের সাহিত্যকে বিশ্ব-পরিসরে পৌঁছে দেওয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আঞ্চলিক সাহিত্য সম্মেলন এবং সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে উন্নত চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা অতি প্রয়োজন।’
ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ করে শেখ হাসিনা বলেন, এক সময় সারাদিন বইমেলায় ঘুরে বেড়ানো অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। বিরোধী দলে থাকতেও যেতাম। কিন্তু ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সে সুযোগটি আর পাচ্ছি না। তারপর করোনার কারণে এখন ঘরবন্দি হয়ে পড়েছি। তাই সশরীরে উপস্থিত হতে পারিনি, সবার সঙ্গে দেখা সাক্ষাতের সুযোগ হয়নি। তারপরও ডিজিটাল বাংলাদেশ করেছি বলে আজ ভার্চুয়াল হলেও সংযুক্ত হতে পেরেছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের বাংলা ভাষার উপর বার বার আঘাত এসেছে। বাঙালি এই সব আঘাত বার বার মোকাবিলা করেছে। ভাষা ও সংস্কৃতি উন্নতি হলে জাতিও উন্নতি করতে পারে। আমাদের ভাষা যেমন আনন্দের, তেমনি প্রতিবাদেরও।’
বইমেলা এক মাস চালানো যেতে পারে বলেও অভিমত ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী। পরিস্থিতি বিবেচনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের আহ্বান জানান তিনি। তিনি বলেন, ‘এবার তো আমরা মেলা দেরিতে শুরু করেছি। আমার মনে হয়, এটা পুরো মাসই চালাতে পারি। যেহেতু প্রকাশকদের কাছ থেকে দাবি এসেছে, জাতির পিতার জন্মতারিখ ১৭ মার্চ পর্যন্ত মেলা চালানোর। আমার মত, এটা আমরা মার্চ মাস পর্যন্ত চালাতে পারি। বাকিটা আপনাদের সিদ্ধান্ত।’
এসময় বাংলাভাষার অভিন্ন ফ্রন্ট চালুর বিষয়েও গুরুত্বারোপ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সবাইকে টিকা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সবাই টিকা নেবেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন। এতে অন্তত নিজেকে সুরক্ষিত রাখা যায়।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান:
শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার নেতৃত্বে সাংস্কৃতিক সংগঠন সুরের ধারা’র শিল্পীদের সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশন এবং ঐতিহাসিক ভাষার গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মূল অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে মহান ভাষা আন্দোলনের শহিদ স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
উদ্বোধন অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। শুভেচ্ছা বক্তৃতা করেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবুল মনসুর। প্রকাশক প্রতিনিধি হিসেবে বক্তৃতা করেন বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি আরিফ হোসেন ছোটন। বিশেষ অতিথি হিসেবে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এমপি। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন।
উদ্বোধন অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন নূরুন্নাহার খানম এবং ড. শাহাদাৎ হোসেন।
বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রদান:
অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-২০২১ প্রদান করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এমপি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক এবং অনুপস্থিত তিনজন লেখকের প্রতিনিধির হাতে তিন লক্ষ টাকার চেক, ক্রেস্ট ও সম্মাননাপত্র তুলে দেন।
পুরস্কার গ্রহণ করেন কবিতা আসাদ মান্নান ও বিমল গুহ, কথাসাহিত্যে ঝর্ণা রহমান ও বিশ্বজিত চৌধুরী, প্রবন্ধ গবেষণায় হোসেনউদ্দিন হোসেন, অনুবাদে আমিনুর রহমান ও রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী, নাটকে সাধনা আহমেদ, শিশু সাহিত্যে রফিকুর রশীদ, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণায় পান্না কায়সার, বঙ্গবন্ধুবিষয়ক গবেষণায় হারুন-অর-রশিদ, বিজ্ঞান/কল্পবিজ্ঞান/পরিবেশবিজ্ঞানে শুভাগত চৌধুরী, আত্মজীবনী/স্মৃতিকথা/ভ্রমণকাহিনিতে সুফিয়া খাতুন (পক্ষে ফেরদৌসী মজুমদার) ও হায়দার আকবর খান রনো (পক্ষে অনন্যা লাবনী) এবং ফোকলোরে আমিনুর রহমান সুলতান।
এক নজরে এবারের বইমেলা:
অমর একুশে বইমেলা-২০২২ এর মূল প্রতিপাদ্য-‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী’।
এই বইমেলা ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন দুপুর ২টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। রাত ৮ টার পর নতুন করে কেউ মেলায় প্রবেশ করতে পারবেন না। ছুটির দিন বইমেলা সকাল ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চলবে। এ ছাড়া মহান একুশে ফেব্রুয়ারি মেলা শুরু হবে সকাল ৮টা থেকে চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত।
বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ এবং ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রায় সাড়ে ৭ লাখ বর্গফুট জায়গায় বইমেলা অনুষ্ঠিত হবে। মেলায় মোট ৩৫ টি প্যাভিলিয়নসহ একাডেমি প্রাঙ্গণে ১০২টি প্রতিষ্ঠানকে ১৪২টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৪৩২টি প্রতিষ্ঠানকে ৬৩৪টি ইউনিট; মোট ৫৩৪ টি প্রতিষ্ঠানকে ৭৭৬ টি ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
ফেব্রুয়ারি মাসের ১ তারিখ থেকে বইমেলা শুরু হওয়ার রীতি থাকলেও করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে দুই সপ্তাহ পিছিয়ে এবার ১৫ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে বইমেলা শুরু হলো। বইমেলা ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে। তবে করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির উন্নতি হলে মেলা ১৭ মার্চ পর্যন্ত বাড়ানো হতে পারে।
এপি/