সমাজসেবায় একুশে পদক পেলেন দই বিক্রেতা জিয়াউল হক
জিয়াউল হক। ছবি: সংগৃহীত
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সীমান্তঘেঁষা ভোলাহাট উপজেলার মুসরিভূজা গ্রামের বাসিন্দা জিয়াউল হক (৯১)। পেশায় তিনি একজন সাধারণ দই বিক্রেতা হলেও তার নেশা সমাজসেবা। দই বিক্রির টাকায় তিনি তৈরি করেছেন লাইব্রেরি।
এছাড়া স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই দেওয়াসহ সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত অনুদান দেন জিয়াউল হক। তাই তাকে সবাই চেনে সাদা মনের মানুষ হিসেবে।
সম্প্রতি বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ দেশের ২১ জন নাগরিককে একুশে পদক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ১৩ ফেব্রুয়ারি সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব আইরীন ফারজানার সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে পদকপ্রাপ্তদের তালিকা প্রকাশ করা হয়। সেই তালিকায় নাম রয়েছে প্রত্যন্ত অঞ্চলের দই বিক্রেতারও। সমাজসেবায় অবদান রাখায় এই পদক পাচ্ছেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জিয়াউল হকের বাবার নাম মরহুম তৈয়ব আলী মোল্লা এবং মায়ের নাম শরীফুন নেছা। তার বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ভোলাহাট উপজেলার ৩ নম্বর দলদলী ইউনিয়নের চামা মুশরিভুজা গ্রামে। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর বর্তমানে তিনি বটতলা গ্রামে দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করছেন।
জিয়াউল হক ১৯৫৫ সালে পঞ্চম শ্রেণি পাস করে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হতে চান। কিন্তু বাড়ি বাড়ি গরুর দুধ দহন করে জীবিকা নির্বাহ করা বাবা বই কেনার জন্য দেড় টাকা দিতে পারেননি। এই কারণে উচ্চবিদ্যালয়েও ভর্তি হওয়া হয়নি তার। এরপর বাবার সংগ্রহ করা দুধ দিয়ে দই তৈরি করে ফেরি করে বিক্রি করা শুরু করেন। দু–তিন বছর পর কিছু টাকা জমা হয় জিয়াউল হকের হাতে। তখন জিয়াউল হকের চিন্তা হয়, যারা তার মতো টাকার অভাবে বই কিনতে না পেরে লেখাপড়া থেকে ছিটকে পড়তে পারে, তাদের তিনি এই টাকা দিয়ে বই কিনে দেবেন। তবেই তার বিদ্যালয়ে পড়তে না পারার বেদনা লাঘব হবে।
আর এই লক্ষ্য সামনে রেখে গরিব ছাত্রদের মধ্যে বই বিলি শুরু করেন। যতদিন পর্যন্ত সরকার বই বিনা মূল্যে দেওয়া শুরু করেনি, ততোদিন পর্যন্ত বই দিতে থাকেন। এরপর উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক শ্রেণির ছাত্রদের বই দিতে থাকেন জিয়াউল। তার দেওয়া বই পড়ে ও আর্থিক সহায়তা পেয়ে অনেকেই স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে চাকরি করছেন। শুধু তা–ই নয়, দই বিক্রি করা টাকায় বইয়ের ভান্ডার গড়ে তোলেন। ১৯৬৯ সালে নিজের বাড়ির একটি ঘরে প্রতিষ্ঠা করেন ‘জিয়াউল হক সাধারণ পাঠাগার’। এ পাঠাগারে এখন ১৪ হাজার বই আছে বলে জানা গেছে।
ভোলাহাট উপজেলার স্থানীয় বাসিন্দা জামিল। তিনি বলেন, ৬৫ বছর ধরে জেলার বিভিন্ন স্থানে সাইকেলে চেপে মাথায় দই নিয়ে বিক্রি করেন জিয়াউল হক। আর এ দই বিক্রি থেকে যে টাকা আয় হয়, তা দিয়েই সমাজসেবা চালিয়ে যান। এলাকার শত শত মানুষের উপকার করেছেন তিনি। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও অনুদান দিয়েছেন। এমনকি, কেউ টাকার অভাবে পড়ালেখা করতে পারছেন না শুনলে তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন সবসময়।
একুশে পদকপ্রাপ্ত জিয়াউল হক জানান, ২০২৪ সালের একুশে পদকপ্রাপ্তদের তালিকায় আমার নামও রয়েছে। বিষয়টি মঙ্গলবার (১৩) ফেব্রুয়ারি বিকেলে সাংস্কৃতিক বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একজন উপ-সচিব আমাকে জানান। এতে আমি ভীষণ আনন্দিত। এই পদক আমার সমাজসেবাকে আরও অনুপ্রাণিত করবে।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক একে এম গালিব খাঁন বলেন, সাদা মনের মানুষ জিয়াউল হক রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা পাওয়ায় আমরা অত্যান্ত আনন্দিত। সেই সঙ্গে জেলাবাসীও আনন্দিত।