উদ্বোধনী মঞ্চায়নে প্রশংসিত নাটক ‘জনকের অনন্তযাত্রা’
বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ অর্জন হচ্ছে স্বাধীনতা। আর সেই স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি মহাকাব্যিক দ্যোতনা এবং নায়োকোচিত ঔজ্জ্বল্য নিয়ে বাঙালির ইতিহাসে ভাস্বর হয়ে আছেন। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিকে যখন জাতির পিতা তার সুচিন্তিত পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন, তখনই দেশী-বিদেশী অপশক্তির ষড়যন্ত্রে শিকার হয়ে সপরিবারে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে তাঁকে। জাতির পিতাকে হারানোর দুঃসহ ক্ষত বাঙালী জাতিকে আজও ব্যথাদীর্ণ করে। সেই বেদনাত্মক অধ্যায় এবং বঙ্গবন্ধুকে দাফনের সত্যাশ্রয়ী ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে নির্মিত হয়েছে ‘জনকের অনন্তযাত্রা’ শিরোনামের নাটক। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপনের অংশ হিসেবে মঞ্চে এসেছে নাটকটি। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি প্রযোজিত নাটকটির উদ্বোধনী মঞ্চায়ন হয় শনিবার (৪ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায়। আজ রবিবার (৫ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় একই ভেন্যু একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে নাটকটির দ্বিতীয় প্রদর্শনী হবে।
নাটকটি রচনার পাশাপাশি নির্দেশনা দিয়েছেন মাসুম রেজা। প্রযোজনাটির উপদেষ্টা শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী।অসাধারণ নাট্যভাবনা, সুনিপুন অভিনয়ের উদ্বোধনী মঞ্চায়নেই প্রশংসিত হয়েছে। মঞ্চায়ন শেষে মিলনায়তন ভরা দর্শক-শ্রোতাদের কাছে পেয়েছে আকুণ্ঠ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
মঞ্চায়নের আগে সংক্ষিপ্ত আলোচনায় লিয়াকত আলী লাকী বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘাতকরা ভাবতে পারেনি, বীরের কখনো মৃত্যু হয় না। বাঙালি জাতির চিরন্তন বীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মৃত্যুর পরও স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। আর তাই, হাজার বছরের শিল্প-সাহিত্য-শিক্ষা-ক্রীড়া-সংস্কৃৃতি সবখানেই তিনি আছেন সগৌরবে। সংশয়হীনভাবে বলা যায়, বঙ্গবন্ধুর যাপিত জীবন, বেড়ে ওঠা, বিকশিত হওয়া, বাঙালির জন্য তার আপোসহীন সংগ্রাম এবং তার প্রয়াণ- সব কিছুর মধ্যেই রয়েছে মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনা। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের মহাকাব্যিক দ্যুতিতে কেউ চাইলে নিজেকে আলোকিত করে নিতে পারে এবং তার ভেতরের সব অন্ধকার অনায়াসেই দূর হতে পারে
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু পরিবারের ওপর ঘটে যাওয়া ইতিহাসের নির্মমতার পর তাকে সমাধিস্থ করার ঘটনা নিয়ে আবর্তিত হয়েছে নাটকের কাহিনী। এ প্রসঙ্গে নাট্যকার ও নির্দেশক মাসুম রেজা বলেন, এই নাটকটি আমার কাছে সত্যাশ্রয়ী গল্প কিংবা গল্পাশ্রয়ী সত্য। দীর্ঘদিন ধরে গবেষণার মাধ্যমে মঞ্চে এসেছে নাটকটি। এ ঘটনায় যারা সরাসরি উপস্থিত ছিলেন তাদের অনেকের ভিডিও ও লিখিত সাক্ষাতকার দেখেছি। বঙ্গবন্ধুকে দাফনের দায়িত্ব পড়েছিল মেজর হায়দার আলীর কাঁধে। একটি বইয়ে এ বিষয়ে তার লেখা আছে। তবে নাটকটি লেখার চেয়ে চ্যালেঞ্জিং ছিল মঞ্চে আনা। আমার কাছে মনে হয়, ইতিহাস বিকৃতির চেয়ে ভয়ংকর ইতিহাসের বিস্মৃতি। বঙ্গবন্ধুর দাফনের বিষয়টি সামনে এলেই মানুষের মনে শুধু ৫৭০ সাবান দিয়ে গোসলের বিষয়টি আসে। কিন্তু, তাকে দাফনের জন্য যখন টুঙ্গিপাড়ায় নিয়ে যাওয়া হয়, তখন এত সব ঘটনা ঘটেছিল গবেষণা না করলে জানতেও পারতাম না। আড়ালে থেকে যাওয়া সেই ঘটনাটিই মেলে ধরেছি নাটকটিতে। এমন রিয়েলিস্টিক গল্পকে মঞ্চের ভাষায় উপস্থাপন করা ছিল দুরূহ কাজ। ঘটনাটি দুই-তিনটি জায়গায় ঘটেছিল। সেগুলোর জন্য সেভাবে সেট তৈরি করতে হয়েছে। পাশাপাশি চাওয়া ছিল প্রত্যেক শিল্পী যেন রিয়েলিস্টিক অভিনয় করেন।
নাটকটিতে অভিনয় করেছেন দেশের বিভিন্ন নাট্যদলের প্রথম সারির বেশ কয়েকটি নাট্যদলের সদস্যরা। এর মধ্যে আছেন আজিজুল হাকিম, মুনিরা ইউসুফ মেমী, কামাল বায়েজিদ, সায়েম সামাদ, শামছি আরা সায়েকা, রামিজ রাজু প্রমুখ। এই নাটকের মাধ্যমে অনেক দিন পর মঞ্চে ফিরেছেন আজিজুল হাকিম, মুনিরা ইউসুফ মেমী ও কামাল বায়েজিদ। বঙ্গবন্ধুর দাফন যেন শরিয়ত মোতাবেক হয়, তার জন্য প্রথম প্রতিবাদ করেন টুঙ্গিপাড়ার মাওলানা আবদুল হালিম। সেই চরিত্রে অভিনয় করেছেন আজিজুল হাকিম। তার স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন মেমী। খন্দকার মোশতাকের চরিত্রে অভিনয় করেছেন কামাল বায়েজিদ। নাটকের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র কর্নেল রউফের চরিত্রে অভিনয় করেছেন সায়েম সামাদ। এ ছাড়া অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন সৈয়দা শামছি আরা সায়েকা, সাজ্জাদ আহমেদ, খন্দকার তাজমি নূর প্রমুখ।