শেষ কথা ২৩শে এপ্রিল...
-ত্রিদিব, আমার এনএবিসি যাওয়া হবে না।
-আহা, আপনি এখনই নেগেটিভ ভাবছেন কেন দাদা? যথেষ্ট সময় আছে। ডক্টর তো আপনাকে ফোনে বললেন, চলে যাইয়ে।
- আমি তো আমার শরীরটা বুঝি। গৌতম আমার খুব প্রিয় ছেলে, বিজনেস ক্লাস টিকিট পাঠাচ্ছে, সব ঠিক। কিন্তু অতটা পথ, প্রায় ১৮ ঘণ্টার ফ্লাইট, নাহ্, পারব না। তুমি বরং আমার বাংলাদেশের ভিসাটা করিয়ে দাও। আধঘণ্টার ফ্লাইট, 'বাংলাদেশ প্রতিদিন' থেকে বারবার বলছে, শুনলাম তোমরাও যাচ্ছ, তোমাদের সঙ্গে যাব।
- সে করিয়ে দিচ্ছি দাদা। আমেরিকার ভিসাটাও হয়ে থাকুক না!
- যা ভালো বোঝ, কর। শুধু শুধু ওদের একগাদা টাকা খরচ করাচ্ছ।
এক বছরের বাংলাদেশ ভিসা হয়ে এল। খুব খুশি। আমার চাপাচাপিতে ইউএস ভিসার ফর্ম পূরণ করতে এলেন আমার অফিসে। গত মাসের মাঝামাঝি। অনেকক্ষণ আড্ডা হলো। কিন্তু সেদিনই মনে হচ্ছিল, ওঁর শরীরে অস্বাচ্ছন্দ্য আছে, হাঁটাচলা করতে কষ্ট হচ্ছে।
গত বছর দুয়েক ধরে প্রায় রোজ সকালেই ফোনে কথা হতো। উনি করেছেন, আমি করতে ভুলে গেছি, অমনি প্রবল অভিমান, তুমি তো এখন অনেক বড় ব্যাপার ! আমাকেই তোমার খোঁজ নিতে হবে!
আবার এই ফোনালাপেই আমাদের মধ্যে চলত নানারকম খেলা! কখনো খাওয়া নিয়ে, কখনো লেখা নিয়ে, কখনো বাইরে যাওয়া নিয়ে, অসাধারণ সব 'গুল'। আমিও পালটা দিতাম, চলত সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি। কখনো গুল ধরা পড়লে খেপেও যেতেন। এই যেমন গত ডিসেম্বরে আমেরিকা থেকে কবি গৌতম দত্ত এসেছে। দেখা করবে।
- সমরেশদা, কাল বাড়ি আছেন তো? গৌতমকে নিয়ে যাচ্ছি। এনএবিসি নিয়ে আপনার একটা ভিডিও রেকর্ড করবে।
- কাল এস না, পরশু। আমি কল্যাণীতে একটা অনুষ্ঠানে যাচ্ছি কাল।
- কল্যাণীতে অনুষ্ঠান! জানি না তো।
- মানে! সব খবর তোমাকে জানাতে হবে নাকি? আমি কাল বাড়ি থাকছি না।
আমিও ছাড়ার বান্দা নই, সঙ্গে সঙ্গে দোয়েলকে ফোন। সে অবাক, কী বলছ কাকু? বাবা সবে অসুখ থেকে উঠল, এখন কোথায় যাবে? বাড়িতেই থাকবে।
ও দাদা, দোয়েল যে বলল, আপনি আছেন। গৌতম অল্প কটাদিনের জন্যে এসেছে।
কয়েক মুহূর্ত নিশ্চুপ। তারপর বোম ফাটল, মেয়েরা কি আমার ঘেঁটি ধরে বসে আছে, অ্যাঁ? তুমি ওদের দিয়ে ভেরিফাই করাও কেন? ভেরি ব্যাড। আমি বলেছি, কাল দেখা করব না, ব্যাস। পরশু আসতে হবে।
কী আশ্চর্য! একদিন পরে যখন গেলাম, সে অন্য মানুষ। ছাড়তেই চান না। কত পুরোনো স্মৃতি। ২০০৯ সাল। তখন গৌতমের বিরাট জিপ ছিল। সেই গাড়ির মাথায় বইমেলার বই তুলে সঙ্গে আরেক গৌতমদা (ফিল্ম ডিরেক্টর) কে নিয়ে নিউইয়র্ক থেকে নিউ জার্সি যাত্রা... সুনীলদা, স্বাতী বউদিকে নিয়ে গভীর রাত অব্দি আড্ডা... পুরোনো কথা আর ফুরোচ্ছে না। সমরেশদা বলছেন, তোমার মনে আছে ত্রিদিব, গৌতমের বাড়ির সামনের বনে হরিণের দল ...ওদের চোখগুলো সোনার ফুলের মতো জ্বলছিল। তারপর মুষলধারে বৃষ্টি নামল।
সমরেশদা, নিউ জার্সির সেই রাতের কাণ্ডটা ভুলে গেলেন? গৌতম বলল, আপনাদের থাকার জন্যে ওরা মোটেল ভাড়া করেছিল। ডিনারের পরে আপনাদের নিয়ে মোটেলে এলাম। তখন রাত প্রায় ১২টা, উইকএন্ড। চাবি নিলাম রিসেপশন থেকে। তারপর যেই আপনি একটা ঘরে চাবি দিয়ে তালা খুলেছেন, অমনি ভেতর থেকে ---
হ্যাঁ, ওরেব্বাপস! সাত ফুটিয়া একটা ব্ল্যাক বেরিয়ে এল। পরনে শর্ট প্যান্ট, পেছনে ওর বান্ধবী। এই মারে তো সেই মারে! তুমি শেষে ওকে বুঝিয়ে --- নইলে কপালে দুঃখ ছিল!
দোষটা পুরো ম্যানেজারের দাদা। মেলা কমিটি রুম বুক করে রেখেছিল। আসছি না দেখে ব্যাটা অন্য ফ্লাইং কাস্টমারদের দিয়ে দিয়েছে। ভেবেছে আমরা আসব না।
১০ মিনিটের জন্যে দেখা করবেন বলেছিলেন, কিন্তু আর ছাড়তেই চান না। শেষমেশ একরকম জোর করে আমরা যখন বেরিয়ে এলাম, রাত ১১ টা।
অথচ এই সমরেশ মজুমদারই আমায় দিনের পর দিন ঘুরিয়েছেন। অনীশ (দেব) দাকে খুব ভালোবাসতেন। তাঁর সঙ্গে গেছি। তখনো বলেছেন, 'দ্যাখো, আমি ত্রিদিবকে নতুন বই দিতে পারব না। পুরোনো বই দেব। ও বেচতে পারবে না। তখন ও আমায় দেখে পালিয়ে বেড়াবে। মাঝখান থেকে সুন্দর সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে যাবে। এইটা আমি চাই না।' অনীশদা জোর দিয়ে বলেছেন, আপনি দিয়েই দেখুন না!
কী ম্যাজিক ঘটল, জানি না। এই মানুষটাই আবার এর বছর তিনেকের মধ্যে সুনীলদা, শীর্ষেন্দুদা, সুচিত্রাদিকে ফোন করে বলেছেন, আমাদের প্রকাশনাকে বই দিতে। গভীর ভালোবাসা, অপার স্নেহ। বাইরেটা শক্ত নারকেলের মতো, ভেতরে কুলকুল করে বইছে মধুর রস। সুনীলদার মতো সকলের সঙ্গে মিশতে পারতেন না, কিন্তু ওঁর ভালোবাসার ছোট বৃত্তে যারা একবার স্থান পেয়েছে, তারা সেই চুম্বক আকর্ষণ থেকে বেরোতে পারেনি।
আমি যে বই সমরেশ মজুমদারের কাছে চেয়েছি, পেয়েছি। ধারাবাহিক সিরিজ লিখছেন, কলিকাতায় নবকুমার, দাউ দাউ আগুন, বা স্বপ্নেই এমন হয়, সোনার শিকল... এমনকী বৃহৎ প্রকাশকের কাছ থেকে তুলে দিয়ে দিলেন ' গল্পসমগ্র ' সিরিজ। কোভিডের সময়ে সরাসরি পাণ্ডুলিপি থেকে লিখে দিলেন দু-দুটো বই। কেন যে এত বিশ্বাস করতেন, কে জানে! শুধু আমাকে কেন, চুমকি, আমাদের দুই মেয়ে ... সবাইকেই। কিন্তু বাইরে খোঁচাতে ছাড়তেন না, যত বইই তোমায় দিই, রয়ালটি তোমার ফিক্সড, সে বাড়বে না!
সমরেশদার হাত ধরেই প্রথম আমার আমেরিকা, কানাডা যাওয়া। 'চলো, দেখবে, ওদেশে কত বাঙালি বাংলা বইয়ের জন্য মুখিয়ে আছে।' কিন্তু দাদা, ফ্লাইটের ভাড়া? কোত্থেকে পাব? 'আরে দাঁড়াও, সে ব্যবস্থা করছি।' করলেনও। তারপর গিয়ে উঠলাম, দাদার রক্তের সম্পর্কহীন বাংলাদেশি কন্যা শ্যামার বাড়ি। দু-দুবার। তার ওখানে একসাথে দিনের পর দিন, রান্নাবান্না করে খাওয়া, উহ, এখন মনে হয়, সব স্বপ্ন। সেখানেও কত ঘটনা, কাহিনি।
কোথায় না কোথায় গেছি দাদার সঙ্গে। ঢাকা, পুরুলিয়ার ভালোপাহাড় থেকে ডুয়ার্সের চা-বাগান, শিলচর থেকে শিলিগুড়ি, গৌহাটি, দিল্লি,ব্যাঙ্গালোর, লখনৌ। আরেকটা বিচিত্র ব্যাপার, ধীরা বউদি আর দুই মেয়ে দোয়েল, পরমা, তারাও আমায় ভারি ভরসা করতেন। বউদি একবার ফোন করে বললেন, আপনার দাদা কী পড়েন জানি না, আমায় কিন্তু কিশোর ভারতী প্রতি মাসে পাঠাবেন।
সিওপিডি, এই রোগটা অনেক দিন ধরেই দাদাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। যে মানুষটা চেন স্মোকার ছিলেন, রোজ সন্ধেয় যাঁর পানীয় লাগত, সব ছেড়ে দিয়েছিলেন বেশ কয়েক বছর। কিন্তু বছর দুয়েক আগে সম্পূর্ণ সুস্থ ধীরা বউদির আকস্মিক চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছিলেন না। একটু একটু করে মানসিক অবসাদে ডুবে যাচ্ছিলেন। প্রায়ই ফোনে বলতেন, ভদ্রমহিলা আমায় ডুবিয়ে দিয়ে গেছেন। আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না।
বেশ কয়েকবার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন দাদা। কিন্তু অসম্ভব মনের জোর, ফিরে এসেছেন, আবার লিখতে শুরু করেছেন। একবার তো বাংলা অক্ষরই ভুলে গিয়েছিলেন! নতুন করে অ আ ক খ প্র্যাকটিস করে লেখায় ফিরলেন। ভাবা যায়!
আমার সঙ্গে শেষ কথা হয় ২৩ এপ্রিল, রবিবার। ২৪ শে এপ্রিল ফোন করতে ভুলে গেছি। ২৫শে এপ্রিল। ব্রেকফাস্ট টেবিলে চুমকি বলল, কী গো, কাল তো সমরেশদাকে কল করোনি। আজ একবার কর। বলতে বলতে ফোন বেজে উঠল, দোয়েল। 'কাকু, বাবার মনে হয়, ফের কিছু হয়েছে। কী রকম করছেন। আমি অ্যাপোলোতে নিয়ে যাচ্ছি।'
ব্যস, তারপর... তার আর পর নেই, নেই কোনো ঠিকানা!
বোঝাতেও পারব না, আমার মনের মধ্যে এখনো কী চলেছে। সব ' বিগ জিরো। '
ত্রিদিব কুমার চট্টোপাধ্যায়: প্রকাশক, পত্রভারতী
এসএন