গগন হরকরা ‘আমি কোথায় পাবো তারে’ গ্রন্থের শাব্দিক আলোচনা
জ্ঞানতাপস সোহেল আমিন বাবু আপাদমস্তক একজন শিশুসাহিত্যিক। শিশুসাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বিচরণ কম বেশি লক্ষ্য করা গেলেও মূলত তার ধ্যান-জ্ঞান ক্ষেত্রানুসন্ধান। তিনি স্বল্পভাষী, ভালো মনের মানুষ, অনেকটা প্রচারবিমুখ। লিখেছেন যত না; তার চেয়ে ঢের দেখেছেন, পড়েছেন। ঔপন্যাসিক সোহেল আমিন বাবু কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার বড়ুরিয়া গ্রামে ১৯৬৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি অতি ছোটবেলা থেকে সত্যানুসন্ধানী। প্রকাশিত গ্রন্থ পঁয়ত্রিশটি। ১৯৯৭ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত তার উপন্যাস ‘প্রেমাটিয়া’ ও ২০১৩ সালে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘কাঙাল হরিনাথ মজুমদার’র কিশোর জীবনী। তিনি শিশু একাডেমি থেকে শিশুসাহিত্যিক পুরস্কারও পেয়েছেন।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গগন হরকরা এবং তার গানকে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছেই শুধু পরিচিত করেননি, তিনি বিশ্বসাহিত্য সভায় গগন ও গগনের গানের সৌন্দর্যকে তুলে ধরেছেন। বিশ্বকবির সঙ্গে গগনের একটা মিষ্টি সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে দু’জন একত্রে বসে বাউল গান শুনতেন। গগনের সংস্পর্শে বিশ্বকবিও বাউল হয়ে উঠেছিলেন। লিখতে থাকলেন বাউলাঙ্গের গান। গগন হরকরা ‘আমি কোথায় পাবো তারে’ গানটির অবিকল এবং অনুকৃত সুরে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিস্বিক যুগে লেখেন ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি। বাংলার বাউল কবির সুরে তৈরি গানটিকে বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিষ্ঠা দিলেন আমাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে। আমাদের জাতীয় সংগীতের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের কুষ্টিয়ার মাটির সন্তান বাউল কবি গগন হরকরার গান।
বরেণ্য লোকসাহিত্য গবেষক ড. আনোয়ারুল করীম গগনের মূল্যায়ণে তিনি লিখেছেন, ‘গগন হরকরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময় তার জমিদারি সেরেস্তার সন্নিকটস্থ শিলাইদহ পোষ্ট অফিসের ডাক হরকরা ছিলেন। তিনি লালন ফকিরের সমসাময়িক হলেও বয়সে লালন অপেক্ষা ছোট ছিলেন। যতদূর জানা যায় গগন হরকরা কোনো ফকিরের নিকট সাধনমর্গ শিক্ষালাভ করেননি। লেখাপড়াও খুব সামান্যই জানতেন। তবে বাউল গান রচনায় তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন।...গগন অত্যন্ত দরিদ্রভাবে জীবন যাপন করেছেন। পারিবারিক অভাব-অনটনের মধ্য থেকেও তিনি কখনো তার মনের সুকুমার বৃত্তি নষ্ট করেননি। গগন হরকরার কিছু গান রবীন্দ্রনাথ সংগ্রহ করে শান্তিনিকেতনে নিয়ে যান। কিন্তু এ কথা অনস্বীকার্য, এক সময় তার গান বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বাউলদের মুখে বারবার এসেছে।’
গগন হরকরা নামটি কিংবদন্তির মতো জনশ্রুতিতে শোনা যায়। তাকে নিয়ে মানুষের মুখে মুখে অনেক কাহিনি প্রচারিত আছে। গগনের সময়কালে যাবতীয় নিপীড়ন, মানুষের প্রতিবাদহীনতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার, লোভ, আত্মকেন্দ্রিকতা সেসময়ে সমাজ ও সমাজ বিকাশে গানের মাধ্যমে সবার সামনে তুলে ধরেছেন। তিনি ছিলেন ব্রাত্যমানুষ, সাধারণ মানুষ, সহজ-সরল গ্রাম্য কবি। বাউল ফকির লালনের কালেই একজন সাধারণ বাউল কবি তার গানের বাণী, সুর-সৌন্দর্য দিয়ে সুধী মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন। লালনের কালে গগন হরকরার গান মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে শিলাইদহ ছেড়ে কলকাতায় পৌঁছেছে।
গগন হরকারা নিয়ে এটিই প্রথম আকরগ্রন্থ, এই গবেষণামূলক গ্রন্থে গগনকে নিয়ে রয়েছে সার্বিক আলোচনা। সোহেল আমিন বাবু ‘গগন হরকরা’ গ্রন্থটি কিংবদন্তী পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থটিতে লোকগবেষক ড. আবুল আহসান চৌধুরী’কে উৎসর্গ করেছেন। প্রচ্ছদ করেছেন মোস্তাফিজ কারিগর। প্রকাশক অঞ্জন হাসান পবন। ৬৪ পৃষ্ঠার গ্রন্থটি ২০২৩ সালের গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়েছে। যার বিনিময় মূল্য ৩৩৫ টাকা। গ্রন্থটিতে গগনকে নিয়ে চারজন বিশিষ্ট গবেষকের সাক্ষাৎকার আছে; আছে গগনকে নিয়ে দুস্প্রাপ্য ছবি, কবিতা, ক্ষেত্রানুসন্ধানি তথ্য। এই গ্রন্থটি গগন অনুরাগী গবেষক ও পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করবে, উন্মোচন করবে বাংলা সাহিত্যে, উন্মোচিত হয়েছে আকরগ্রন্থ ‘গগন হরকরা’।