দুই বাংলার উৎসবের দিন
আজ পয়লা বৈশাখ। বাংলা ও বাঙালি জাতির জীবনে অন্যতম উৎসব। দুই বাংলাসহ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা বাংলা ভাষাভাষি মানুষের জীবনে খুব আনন্দের দিন। উৎসবের দিন। পয়লা বৈশাখ এলেই মনে পড়ে ছেলেবেলার কথা। সেসময় বাংলায় বিশেষ করে নববর্ষ পালন করা হত উৎসবের আমেজে, আড়ম্বড়ের সাথে। সে উৎসবে ছিল প্রাণের স্পন্দন। আমরা অপেক্ষা করে থাকতাম এই দিনটির জন্য। পয়লা বৈশাখে নতুন জামা কাপড় পড়ে গুরুজনদের প্রণাম করে আমরা বেরিয়ে পড়তাম । তখন নববর্ষে মেলা হত। সেইসব মেলা ছিল নববর্ষ পালনের এক বড় আকর্ষণ। সেসময় বিশ পয়সা পঁচিশ পয়সা পেতাম মেলায় ঘোরার জন্য। আমরা মেলায় গিয়ে জিলাপি কিনতাম এক পয়সায় চারটি। সেই জিলাপির স্বাদই আলাদা। তারপর নাগরদোলায় চড়তাম। মূল্য ছিল এক পয়সা। সেসব দিন ছিল নির্ভেজাল আনন্দের।
আজ আর সেই দিন নাই। যুগ বদলে গেছে। সঙ্গে বদলেছে আনন্দ উৎসব পালনের রীতিনীতিও। পয়লা বৈশাখের মেলা আজ আর হয় না। মেলায় যা হয়, সবই রাজনীতির লোকেদের দ্বারা পরিচালিত। কোন মেলা কোন দল কোন রাজনৈতিক নেতা করবেন, তার প্রতিযোগিতা চলে। এখন মেলা হয় রাজনৈতিক প্রতিপত্তি নির্ভর। অরাজনৈতিক সবচেয়ে সুন্দর মিলন উৎসবেও ঢুকে পড়েছে নোংরা রাজনীতি। তার সাথে ধর্মীয় বিভাজন আরও এক বিরাট সমস্যা। হিন্দু মুসলিম বিভাজন এখন বর্ষবরণ উৎসবেও ঠাই নিয়েছে। আর সবটাই করা হচ্ছে রাজনৈতিক উৎসব চরিতার্থ করতে। অথচ বঙ্গাব্দ সূচনার ইতিহাস দেখলে আমরা দেখতে পাবো, সেখানে এমন কোন ধর্ম বিভাজনের প্রশ্নও ছিল না।
ইতিহাস সংস্কৃতি বিষয়ক তথা রাজ্যসভা সাংসদ জহর সরকারের মতে, হিন্দু নববর্ষের ডাকের মধ্যে জোর করে হিন্দু সত্তা তৈরির চেষ্টা রয়েছে। বিজেপি বা তাদের মতাদর্শগত পূর্বসুরিরা কোনকালেই ভারতের বহুত্বে নির্ভর সংবিধান, তেরঙ্গা পতাকা এরা মন থেকে মানতে পারে নি। হিন্দু নববর্ষের কথা বলে তারা আদতে এদেশের বহুত্বের আদর্শেরই কিছুটা বেসুরো বাজছেন।
ইসলাম ধর্ম ও মুসলমানদের আঘাত করতে, বারে বারেই সচেষ্ট হয়েছে বিজেপি। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে হিজাব, হালাল, নামাজ ও আজান বন্ধ করতে তৎপর হয়েছে। দিল্লিতেও একই খেলা শুরু করেছে বিজেপি আর এস এস। হিন্দু নববর্ষ পালনের উদ্যোগ এরই একটি অংগ।
এই বৈশাখ বাংলা নববর্ষের প্রথম মাসতো বটেই, পাশাপাশি এই মাসেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাই পয়লা বৈশাখ থেকে পঁচিশে বৈশাখ-বলতে গেলে পুরো বৈশাখ মাসটিই বাঙালির উৎসবের নাম। আগে বর্ষবরণের পাশাপাশি রবীন্দ্রজয়ন্তীও পালিত হত সম্পুর্ণ অরাজনৈতিকভাবে। এখন সে অনুষ্ঠানও রাজনীতি প্রভাবিত । পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলের সর্বময়ী কর্ত্রির অনুপ্রেরণা ছাড়া এখন রবি ঠাকুরের জন্মদিনও পালিত হয় না। একদিকে গোটা দেশে বিজেপি, অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস, দুইদলের সর্বগ্রাসী রাজনীতি গিলে খাচ্ছে সবকিছুই। পহেলা বৈশাখ পঁচিশে বৈশাখ সবই ওই রাহুর গ্রাসে।
পহেলা বৈশাখ আবার আসবে। আসবে প্রতি বছরই। এই আনন্দ উৎসব নিয়ে এমন দূর্ভাগ্যজনক রাজনীতি কতদিন চলবে, সে প্রশ্ন এখন তামাম বাঙ্গালির।
লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক