তুমি নির্মল কর, মঙ্গল কর, মলিন মর্ম মুছায়ে
বাংলা নববর্ষ আমাদের একটি চেতনার নাম। ভালোবাসার নাম। উৎসবের নাম। যতটা না আমরা দিনপঞ্জিকা অথবা ক্যালেন্ডার হিসেবে ব্যবহার করি, তার চেয়ে ভালোবাসার, চেতনার, সবচেয়ে বড় কথা, বাঙ্গালির যে সারাবৎসর আমাদের হৃদয়ে ধারণ করি তা-ই হল নববর্ষ। ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ি দিন, ক্ষণ অফিসসহ সবকিছুই চলে। পৃথিবীর সঙ্গে সংযোগ রাখতে হলে আমাদের ইংরেজি ক্যালেন্ডারই অনুসরণ করতে হয়। বাংলা নববর্ষ একটি উৎসব হয়ে আছে। বাংলা ক্যালেন্ডার মানে পালা পার্বণের মাস, এটি আমার একটি মন খারাপের কারণ। কিন্তু আমি ছোটবেলা থেকেই দেখেছি, যেহেতু আমি গ্রামের ছেলে, সেখানে যে মেলা হত, সেটি আমাদের জন্য খুবই আনন্দের ছিল। নানা রকম মুড়ি, মুড়কি, হাড়ি,পাতিলসহ সবই ছিল মাটির, সেগুলি নিয়ে গান ও পুথিপাঠ হত, সঙ্গে নাচ হত, আমরা এগুলি দেখতাম। সবাই প্রচণ্ড ভিড় করে মেলা দেখতে আসতো। এটি আমাদের জন্য সবচেয়ে বিরল ব্যাপার ছিল। ঢাকা এসে যেটি দেখলাম, ছায়ানটে ভোরবেলায় চমৎকার গান হত, আমিও এসবের সাথে যুক্ত ছিলাম। ওয়াহেদ বারী, সানজিদা খাতুনসহ সবাই আমরা একসাথে আয়োজনে অংশ নিয়েছি। পরবর্তীতে আনন্দ মিছিল আমাদের চারুকলা থেকে যেটি হত, সেটি কিন্তু অপূর্ব সুন্দর ছিল।
যতকিছুই হোক, বাংলা নববর্ষ বাঙ্গালিত্বের চেতনাকে ধারণ করে। আমাদের যে মুক্তি সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে হয়েছিল, সেটিকে সম্পূর্ণভাবে ধারণ করে। সেটিই হল, বাঙ্গালিত্বের বিরাট পরিচয়। চারদিকে যে অবক্ষয় আমরা দেখছি, নানাভাবে ধর্ম বর্ণ বিভেদ ইত্যাদি আমাদের সংস্কৃতিকে ব্যাহত করছে। আমরা নববর্ষে গিয়েছি, হিন্দু বাড়িতে পূজা দেখতে গিয়েছি। এরাও আমাদের ঈদে এসেছে। আমরা বৌদ্ধদের অনুষ্ঠানে গিয়েছি। আমাদের মাথায় কখনও আসেনি ধর্ম আমাদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু এখন দুঃখের বিষয় এটিই যে, ধর্ম বিভাজন তৈরি করছে। জাতির পিতা বলেছিলেন, সকল ধর্মের, সকল বর্ণের সকল মানুষের দেশ হবে বাংলাদেশ। কাজেই আমি বিশ্বাস করি,দেশে সাম্প্রদায়িকতা যেভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চায়, সেগুলি একসময় থাকবে না। আমাদের সরকার এ ব্যাপারে বেশ সজাগ আছে।
আমরা বাঙালি। আমরা শুধু নববর্ষ না, সকল ধরণের অনুষ্ঠান আমরা পালন করি। আমরা রোজার ঈদ, কোরবানির ঈদ পালন করি। এবার রোজাতে হচ্ছে নববর্ষ। রোজার সম্ভ্রম যেমন আমরা রক্ষা করব, তেমনি নববর্ষের উৎসবও আমরা পালন করব। নববর্ষ সব মানুষের অনুষ্ঠান। সকল দেশের মানুষ এই আয়োজনে অংশগ্রহণ করছে। মানব সভ্যতার শুরু থেকেই সৃষ্টিশীলতা তার ডালপালা বিস্তার ঘটিয়েছে। একইসাথে কিছু আগাছাও যে নেই তা বলব না। কিন্তু সেগুলি পথের অন্তরায় হতে পারেনি। সভ্যতা তার নিজ গতিপথে এগিয়ে গিয়েছে। সেই সভ্যতার পথে আমরা আছি। আমরা সেই লক্ষে উদ্বেলিত হব, দেশকে ভালোবাসব, মানুষকে ভালোবাসব। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ভালোবাসব কারণ, তার মত বাঙালি হাজার বছরেও হয় না।
এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, তুমি নির্মল কর, মঙ্গল কর, মলিন মর্ম মুছায়ে…
আমাদের ছেলেবেলায় মঙ্গল কামনা করেই নববর্ষের মেলা হত। মঙ্গল চিন্তা থেকেই মুড়ি মুড়কি চিনি দিয়ে তৈরি হত নানা রকম খাবার। আমরা সেগুলি কিনে খেতাম। সেই বয়সে হিন্দু-মুসলিম কে? বৌদ্ধ খ্রিস্টান কে? এসব কখনও ভাবনায় আসেনি। এখনও মানব ধর্মকে সবচেয়ে বড় বলে মনে করি। কাজেই সেই ছেলেবেলার মত নির্ভেজাল আনন্দটুকু যেন আমরা ফিরে পাই সেটিই কাম্য।
নববর্ষের আনন্দ মিছিল, শোভাযাত্রা এবং নববর্ষের মূল চেতনা হল, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। আমরা সেটিরই ঝাণ্ডা উড়াই। আমরা মানুষকে নতুন করে মনে করিয়ে দিই যে, আপনারা ভুলে যাবেন না, আজকাল চতুর্দিকে যেসব ঘটনা ঘটছে, শুধু মনে করিয়ে দিতে চাই যে, আমাদের দেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। বাংলাদেশ প্রত্যেক ধর্ম জাতি বর্ণের বাংলাদেশ। নির্বিশেষে প্রতিটি খেটে খাওয়া মানুষ থেকে শুরু করে, মাটির কাছাকাছি মানুষ, প্রত্যেকেরই বাংলাদেশ। এখানে কোথাও নিরাশা নেই, হতাশা নেই, কোথাও কোন বৈষম্য নেই। এই কথাটিই সবচেয়ে জরুরি আমার কাছে।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব