শ্রদ্ধা ভালোবাসায় সিক্ত হাসান আরিফ
কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে দাঁড়িয়ে বজ্রকণ্ঠে আবৃত্তি করে মুগ্ধ করতেন সবাইকে। অপশাসন, অনিয়ম, অশুভ তৎপরতার বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক জাগরণের ডাক দিতেন। সংগঠিত করে নিয়ে আসতেন তরুণ প্রজন্মকে। দেশবরেণ্য মানুষদের শ্রদ্ধা জানানোর আয়োজন করতেন সুচারুভাবে। আজও চিরচেনা সেই কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে এলেন তিনি। তবে একদম প্রাণহীন, নিথর দেহে। মাইকে বাজছে তার বজ্রকণ্ঠের আবৃত্তি। এভাবে নিথর দেহে তাকে দেখে অশ্রুসিক্ত পরিবার, স্বজনসহ তার দীর্ঘদিনের সহকর্মী ও সাংস্কৃতিক যোদ্ধারা।
খ্যাতিমান আবৃত্তিশিল্পী ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফের মরদেহ সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আনা হয় শনিবার (২ এপ্রিল) সকাল ১১টা ১০ মিনিটে। বেলা ১টা পর্যন্ত সংস্কৃতিসেবী, রাজনীতিবিদ ও বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের শ্রদ্ধা ভালোবাসায় সিক্ত হলেন দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অগ্রসেনানী হাসান আরিফ।
শহিদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। প্রথমেই শ্রদ্ধা জানান জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার এমপি। এরপর একে একে শ্রদ্ধা জানান, বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা। সবার প্রিয় সাংস্কৃতিক সংগঠক হাসান আরিফের শেষ যাত্রায় শ্রদ্ধা জানাতে কেবল ঢাকা নয়, ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলার সাংস্কৃতিক জোটের কর্মীরাও জড়ো হন শহিদ মিনারে। শ্রদ্ধা জানাতে আসা অনেককেই নীরবে অশ্রুপাত করতে দেখা গেছে।
মাহবুবুল হক হানিফ, ডা. দীপু মনি, ড. হাছান মাহমুদ, শফিউল আলম নাদেল, আফজাল হোসেনের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ শ্রদ্ধা নিবেদন করে। এ ছাড়াও আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, দপ্তর সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রী’র বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া শ্রদ্ধা জানান। শ্রদ্ধা জানায় কেন্দ্রীয় যুবলীগ, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।
শ্রদ্ধা জানায় বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি, সংগীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদ, জাতীয় কবিতা পরিষদ, গণসংগীত সমন্বয় পরিষদ, বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদ, নৃত্যশিল্পী সংস্থা, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, সেক্টর কমান্ডরস ফোরাম, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, জয়বাংলা সাংস্কৃতিক ঐক্যজোট, মহিলা পরিষদ, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, কণ্ঠশীলন, বহ্নিশিখা, ঋষিজ, ক্রান্তি; দনিয়া সাংস্কৃতিক জোট, কচিকাঁচার মেলা, মহাকাল, বাংলাদেশ পুলিশ থিয়েটার, পদাতিক নাট্য সংসদ, সংস্কৃতি সংসদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় কিশোরগঞ্জ, শ্রুতিঘর, সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্র, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, দেশ নাটক, সত্যেন সেন শিল্পী গোষ্ঠী, সুরতান, বঙ্গবন্ধু শিল্পীগোষ্ঠী, সুরসাগর ললিতকলা একাডেমি, ঢাকা পদাতিক, রোভার স্কাউট, ঢাকা থিয়েটার, বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার, বাক শিল্পাঙ্গন, ডিরেক্টরস গিল্ড, কথা আবৃত্তি চক্র, ইউনিভার্সেল থিয়েটার, ঝিনাইদহ সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট. কক্সবাজার সাংস্কৃতিক জোট, গাজিপুর সাংস্কৃতিক জোট, সাভার সাংস্কৃতিক জোট, গাজীপুর সাংস্কৃতিক জোট, আরণ্যক নাট্যদল, দনিয়া পাঠাগার, কথক থিয়েটার, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক ফোরাম, মুক্তবাক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, থিয়েটার, সম্প্রীতি বাংলাদেশ, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, স্বরকল্পন, প্রজন্ম একাত্তর, শর্ট ফিল্ম ফোরাম, ছায়ানট, জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ, বোধন চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, সাতক্ষিরা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, ছাত্রমৈত্রী, সহজপাঠ, স্বরশ্রতি প্রভৃতি সংগঠন।
বিশিষ্টজনদের মধ্যে মফিদুল হক, আবৃত্তিশিল্পী ভাস্বর বন্দোপাধ্যায়, ডালিয়া আহমেদ, শিমুল মোস্তাফা, কণ্ঠশিল্পী রফিকুল আলম, তিমির নন্দী, সাবেক ছাত্রনেতা শফি আহমদ, চিত্রশিল্পী কামাল পাশা চৌধুরী, লেখক শাকুর মজিদ, অধ্যাপক কামরুল আহসান খান, চিত্রশিল্পী অধ্যাপক নিসার হোসেন, সাংবাদিক হারুন হাবীব, লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির, কাজল দেবনাথ, ড. মুহাম্মদ সামাদ, লিয়াকত আলী লাকি, কবি তারিখ সুজাত, সুভাস সিংহ রায়, এনামুল হক ওমর, অভিনেতা কেরামত মওলা, শংকর সাওজাল, ঝুনা চৌধুরী, ত্রপা মজুমদার, কামাল বায়জিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান প্রমুখ।
শেষ পর্যায়ে হাসান আরিফের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে বক্তব্য রাখেন সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি রামেন্দু মজুমদার, নাসিরউদ্দীন ইউসুফ ও বর্তমান সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ। পরিবরের পক্ষ থেকে কৃজ্ঞতা প্রকাশ করেন হাসান আরিফের ছোট বোন তুলি।
শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা জানানো শেষে জাতীয় পতাকা সামনে রেখে লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স যাত্রা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের উদ্দেশে। সেখানে বাদ জোহর হাসান আরিফের দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
এরপর মরদেহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে হস্তান্তর করা হয়। উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ অনাটমি বিভাগের শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের নিয়ে হাসান আরিফের মরদেহে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময় তিনি বলেন, হাসান আরিফের মতো মানুষদের মরণোত্তর দেহদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
এর আগে শনিবার সকাল ৯টায় ধানমন্ডির বাসার পাশের মসজিদে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
উল্লেখ্য, গত বছরের ২ ডিসেম্বর করোনায় আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন হাসান আরিফ। তিনি দীর্ঘদিন হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। এরপর থেকে নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন এই আবৃত্তিশিল্পী।
বিগত শতাব্দীর আশির দশক থেকে এ দেশের সাংগঠনিক আবৃত্তিচর্চা ও প্রশিক্ষণে অসামান্য ভূমিকা পালন করে আসছেন বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে দেশের সব গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সামনে থেকে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছিলেন।
এএম/এপি/
এ সম্পর্কে আরও পড়ুন :
শহীদ মিনারে হাসান আরিফের মরদেহ, শ্রদ্ধাঞ্জলি শুরু
হাসান আরিফের মৃত্যুতে ১৯৯০ এর ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের শোক
হাসান আরিফের মৃত্যুতে নির্মূল কমিটির শোক প্রকাশ
শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা শনিবার : মরণোত্তর দেহদান করে গেছেন হাসান আরিফ