সারের দাম বাড়ায় 'দুশ্চিন্তায়' ঠাকুরগাঁওয়ের কৃষকরা
সারের দাম বাড়ায় উৎপাদন নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন ঠাকুরগাঁওয়ের কৃষকরা। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে গত আট-নয় মাস ধরে তাদের উপর দিয়ে একধরনের ঝড় বইছে। চড়া মূল্যে কৃষি উপকরণ কিনে ফসল উৎপাদন করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে কোনোভাবেই তাল মেলাতে পারছেন না তারা। অনেক কৃষক পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না।
কৃষকরা বলছেন, গত বছর বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি একেবারে কম হয়েছে। এতে সেচের ব্যয় বেড়েছে। এরপর রয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট। এ অবস্থায় সারের দাম বাড়ানোয় তারা চোখে সরষে ফুল দেখছেন। সবকিছু মিলে এবার কৃষি উৎপাদনের খরচ বাড়বে। সারের দাম বাড়ায় যেন তাদের অবস্থা— মরার উপর খাঁড়ার ঘা।
সার সংক্রান্ত বিষয়ে গত সোমাবার (৩ এপ্রিল) কৃষি মন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক জানিয়েছিলেন, সারের দাম বাড়বে না। মন্ত্রীর এই বক্তব্যের কয়েক দিনেই (মঙ্গলবার ১১ এপ্রিল) সব রাসায়নিক সারের দাম কেজিতে পাঁচ টাকা করে সরকার বাড়িয়েছে।
ঠাকুরগাঁওয়ে এবার বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬০ হাজার ১৫০ হেক্টর জমি। যার ধান উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ২ লক্ষ ৬৭ হাজার ৯৪০ মেট্রেক টন বলে জানান, জেলা কৃষি কর্মকর্তা। আর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (শস্য) আলমগীর কবিরের দেওয়া তথ্য মতে, গত বছর বোরো ধানের ক্রয় মূল্য ছিল ২৬ টাকা কেজি। সেই হিসেবে ২ লক্ষ ৬৭ হাজার ৯৪০ মেট্রেক টন ধানের উৎপাদন লক্ষ্য মাত্রা অনুযায়ী এবার ৬৯৬ কোটি টাকার ধান উৎপাদন হবে এ জেলায়।
নতুন মূল্য তালিকা অনুযায়ী, প্রতি কেজি ইউরিয়া সার ডিলার পর্যায়ে ২৫ টাকা ও কৃষক পর্যায়ে ২৭ টাকায় পাওয়া যাবে।রএকইভাবে ডিএপি ডিলার ১৯ ও কৃষক ২১ টাকা, টিএসপি ২৫ ও কৃষক ২৭ টাকা কেজি দরে এবং প্রতি কেজি এমওপি সার ডিলার পর্যায়ে ১৮ টাকা ও কৃষক পর্যায়ে ২০ টাকায় বিক্রি হবে।
তবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা যায়, চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক বাজারে সারের মূল্যবৃদ্ধিজনিত কারণে সারের আমদানি যৌক্তিক পর্যায়ে রাখা এবং সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে সরকার সারের বিক্রমূল্য পুণঃনির্ধারণ করেছে।
কৃষক আব্দুল আলীম বলেন, কৃষি কাজ করেই তাদের সংসার চলে। কিন্তু বর্তমান যে অবস্থা তাতে কৃষি কাজ করলে না খেয়ে মরতে হবে। সব কিছুর দাম বেশি। কিন্তু তারা ফসলের দাম পান না। সরকার বলে এক রকম, কিন্তু হয় আরেক রকম। এখন ধান লাগানোর মৌসুম। সার ও তেলের দাম বেশি। চাষাবাদ না করলে না খেয়ে মরতে হবে, তাই বাধ্য হয়ে বেশি দামে সার কিনে চাষ করছেন।
সদরের আকচা ইউনিয়নের কৃষক এনতাজুল হক ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, সার, কীটনাশক, ডিজেলসহ কৃষি উপকরণের দাম এভাবে বাড়লে আমাদের কী হবে? এমনিই তো সারের দাম বাড়তি। তার ওপর ধানের দাম কম। এখন যদি এমনভাবে আবারও সারের দাম বাড়তে থাকে, তাহলে কৃষকের তো কোনো উপায় থাকবে না। বস্তায় ৩০০ টাকা বাড়ার মানেতো কৃষকের মরার অবস্থা। তিনি বলেন, সারের দাম বাড়ানো মানে আমাদের লোকসান। সারের দাম যেহেতু বাড়ানো হয়েছে, সেহেতু ধানের দামও বাড়ানো হোক। আর যদি সারের দাম কমানো হয়, তাহলে ধানের দাম যা আছে তাতে আমাদের চলবে।
কৃষক মোহাম্মদ আলী বলেন, এভাবে সারের দাম বাড়তে থাকলে পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকাই দায় হবে। প্রতি বস্তায় সারের দাম ২৫০ টাকা বাড়ায় কৃষকের কষ্ট আরও গেল।
সালন্দর ইউনিয়নের সিংপাড়া এলাকার কৃষক মামুন ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, সবজি চাষ করে সংসার চলে। সারের দাম বেড়েছে বস্তায় ২৫০ টাকা। এর আগের বছর বস্তায় বেড়েছে ৩০০ টাকা। যদি বছর বছর সারের দাম এরকম বাড়ে তাহলে চাষ করব কেমন করে। সারের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি ফসলেরও দাম বাড়ে তাহলে সমস্যা হয় না। কিন্তু আমরা কষ্ট করে উৎপাদন করি দাম পাই না। গত বছর বেগুন করে ৫ টাকা কেজি বিক্রি করতে হয়েছে। এতে আমার ২০ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে। ধার দেনা করে চাষ করার পর যদি এমন হয়, তাহলে তো আবাদ কমিয়ে দিতে হবে। প্রতিবছর লোকসান দিলে বাঁচব কেমন করে।
মাঠে কাজ করতে আসা হাবিবুর ঢাকাপ্রকাশ-কে জানান, সারের দাম বৃদ্ধি করে সরকার অন্যায় করেছে। এভাবে দাম বাড়া ঠিক না। যত কিছুর দাম বাড়ে তাতে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয় গরিব মানুষ। সারের দাম বৃদ্ধির প্রভাব শুধু কৃষকের ওপর গিয়ে পড়বে না শ্রমিকদের ওপরও পড়বে। কেননা তাদের তো পয়সা বেশি দিচ্ছে না। ক্ষেতমজুররা তো বেশি কাজ পায় না। তারা তো বেশির ভাগ সময় বেকার থাকে।
অন্যদিকে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, এখন পর্যন্ত সারের কোনো ঘাটতি নেই। জেলায় চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত পরিমাণে সার মজুদ রয়েছে। সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কেউ বেশি দামে সার বিক্রি করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আরএ/