শীতের আগমণে জীবন্ত হয়ে উঠেছে তাঁতপল্লি
পুঁজি আর মুনাফার কারণেই ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প আজ বিলুপ্তের পথে। সুতা ও কাঁচা মাল, পুঁজির অভাব এবং আধুনিক কাপড়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে একের পর এক তাঁত শিল্প বন্ধ হয়ে গেছে। এ শিল্পের পূর্বপুরুষের ব্যবসার ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন জয়পুরহাটের হস্তচালিত তাঁতশিল্পীরা।
শীতের আগমণে জীবন্ত হয়ে উঠেছে এ জেলার আক্কেলপুর উপজেলার তিলকপুর ইউনিয়নের তাঁতপল্লি। খটখট শব্দে মুখরিত হয়ে উঠেছে। ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন গামছা, তোয়ালে, চাদর ও কম্বল তৈরির কাজে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, জয়পুহাট জেলার আক্কেলপুর উপজেলার তিলকপুর ইউনিয়নের শ্যামপুর, সরস্বতীপুর ও মোহনপুরের তিনটি গ্রামের প্রায় ১ হাজার ২০০ পরিবারের জীবিকার প্রধান উৎস তাঁতশিল্প। এই তাঁতপল্লিতে অল্পসংখ্যক বিদ্যুৎচালিত তাঁত ছাড়া বাকি সবই হস্তচালিত। একসময় শুধু মশারি তৈরি করা হলেও এখন এই তাঁতপল্লিতে তৈরি হচ্ছে গামছা, তোয়ালে, চাদর, কম্বল। সারা বছর কাজ না হলেও শীতের আগমনীতে শীতের পোশাকের জন্য কাজ করেন কারিগররা। এই এলাকার উৎপাদিত গামছা, চাদর, কম্বল ভালোমানের হওয়ায় নিজ এলাকা ছাড়াও নওগাঁ রাজশাহী, রংপুর, ঠাকুরগাঁও, সৈয়দপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও অঞ্চলে বিক্রি করা হয়ে থাকে।
শ্যামপুর গ্রামের তাঁতি আসলাম হোসেন বলেন, নারীদের ব্যবহারের দুই হাত প্রস্থ ও পাঁচ হাত দৈর্ঘ্যের একেকটি চাদর তৈরিতে ৪০০ গ্রাম রুল সুতার প্রয়োজন হয়। পুরুষদের তিন হাত প্রস্থ ও ছয় হাত দৈর্ঘ্যের একেকটি চাদর তৈরি করতে উলের সুতার প্রয়োজন হয় ৫০০ গ্রাম। এক দিনে ১৪-১৬টি চাদর তৈরি করা হয়। অন্যদিকে এক দিনে বড় আকারের সুতি সুতা দিয়ে ১২-১৬টি গামছা তৈরি করা হয়। এ ছাড়া প্রতিটি কম্বল তৈরি করতে প্রয়োজন হয় প্রায় ১ কেজি মখমলের সুতা।
মোহনপুর গ্রামের তাঁতি আশরাফুল ইসলাম বলেন, তাঁতের কাজ করে প্রতি মাসে ১৪-১৬ হাজার টাকা আয় হয়ে থাকে। নারীদের ব্যবহারের প্রতিটি চাদর ১৪০-২৪০ ও পুরুষদের ব্যবহারের চাদর ২৫০-৩০০ টাকায় বিক্রি হয়। কম্বল ২১০-২২০ টাকায় এবং প্রতিটি গামছা ৫০-৫৫ টাকায় পাইকারি দরে বিক্রি হয়। পাশের জেলা বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার সাঁওইল ও সান্তাহার বাজারে এসব চাদর ও কম্বল বিক্রি করেন তাঁতিরা।
তবে বর্তমানে ঠিকমতো সুতা না পাওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে তাদের উৎপাদন কার্যক্রম, যা তাদের বাড়তি আয়ের পথে প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয় কোনো সুতার বাজার না থাকায় পাশের জেলা বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার সাঁওইল বাজার থেকে এই অঞ্চলের তাঁতিরা সুতা সংগ্রহ করেন।
এ ব্যাপারে স্থানীয় ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সিরাজুল ইসলাম বলেন, ব্রিটিশ আমলে ট্রেনে ভারত থেকে সুতা নিয়ে এসে এই এলাকার তাঁতিরা কাজ করতেন। প্রায় ৩০-৪০ বছর আগেও স্থানীয় বাজারে সুতা পাওয়া যেত।
আক্কেলপুর উপজেলার তিলকপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সেলিম মাহবুব বলেন, আর্থিকভাবে সচ্ছল অনেক পরিবার এই পেশা পরিবর্তন করেছে। তবে যেসব পরিবার তাঁতশিল্পের ওপর নির্ভরশীল তাদের স্বল্প সুদে ঋণসহ সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করা হলে তাঁতিরা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখার পাশাপাশি জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটাতে পারবেন।
বেসিক সেন্টার বগুড়া কাহালুর কর্মকর্তা তন্ময় কুমার ঢাকাপ্রকাশ-কে জানান, বগুড়া তাঁতবোর্ডের অধীনে জয়পুরহাট তাঁত সমিতি গঠিত। এর মধ্যে জয়পুরহাটে ৭টি তাঁত সমিতি আছে। এ জেলার কালাই উপজেলায় ৩টি ও আক্কেলপুর উপজেলায় ৪টি সমিতি আছে। তাঁতশিল্পের কর্মরত আছেন ১৫৪ জন। তিনি আরও জানান আমাদের তাঁতবোর্ডের পক্ষ থেকে নিয়মিত তাঁত সমিতিগুলোর তদারকি করা হয়।
এসএন