সুনামগঞ্জে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ
সুনামগঞ্জের হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি-পিআইসি গঠনেই ছিল টাকার খেলা। এ ছাড়া সময় মতো কাজ শুরু না হওয়া, কাজ দেওয়ার পর অর্থ বরাদ্দ না দেওয়া, যেসব কাজ হয়েছে তার সঠিক তদারকি না করাসহ নানা অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। আর এসব অনিয়ম দুর্নীতের হোতা হিসেবে রাজনৈতিক নেতা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডকে (পাউবো) দায়ি করছেন হাওরপাড়ের কৃষক ও স্থানীয় বাসিন্দারা।
গত বৃহস্পতিবার (৭ এপ্রিল) সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার চন্দ্রসোনার থাল হাওরের বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় ডুবাইল ও সুখাইড় রাজাপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের নির্মাণাধীন ঘোড়াচক্কর বাঁধ পরিদর্শনে আসেন পানিসম্পদ উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম। পরিদর্শন শেষে তিনি দৌলতপুর ফেরিঘাট সংলগ্ন এলাকায় এলে উপমন্ত্রীর পথ আগলে দাঁড়ান আব্দুল মালেক নামের এক কৃষক। তখন তিনি অভিযোগ তুলেন হাওরে ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও অর্থের বিনিময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠন বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে। তাদের নাম প্রকাশ্যে এনেছেন ফসল হারানো এই কৃষক।
ধর্মপাশার রাজাপুর বড়হাটি গ্রামের আব্দুল মালেক নামের এক বিক্ষুব্ধ কৃষক উপমন্ত্রীকে বলেছিলেন, টাকার বিনিময়ে কীভাবে কাজ দিয়ে থাকে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি)। এসময় কৃষকের অভিযোগ শুনে স্থানীয় এমপিসহ দলীয় নেতা-কর্মীরা ক্ষিপ্ত হয়ে যান সেই কৃষক আব্দুল মালেকের উপর। যার পুরো চিত্র ঢাকাপ্রকাশের ক্যামেরাবন্দী হয়।
কৃষক আব্দুল মালেক পানিসম্পদ উপমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করে বলেন, ধর্মপাশা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হোসেন রোকন (স্থানীয় সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের ছোট ভাই), উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমেদ বিলকিস ও তার বেয়াই সুখাইড় রাজাপুর উত্তর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আলমগীর কবির, সাধারণ সম্পাদক বদরুল হুদা রাসেলসহ কয়েকজন নেতা ১ লাখ করে টাকা নিয়ে প্রতিটি পিআইসি বিক্রি করেছেন।
এ সময় সেখানে উপস্থিত থাকা স্থানীয় সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, সংরক্ষিত আসনের এমপি শামীমা আক্তার খানম, জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেনসহ পাউবোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সামনে উপমন্ত্রী কৃষক মালেককে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়ে শান্ত করেন।
শুধু ধর্মপাশা উপজেলায়ই নয় একইভাবে সুনামগঞ্জ জেলার অন্যান্য হাওরগুলোতেও একই চিত্র। পিআইসি গঠনে স্বেচ্ছাচারিতার অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। জেলার জগন্নাথপুরের সর্ববৃহৎ নলুয়া হাওরের কয়েকটি ফসল রক্ষা বেড়িবাঁধ বার বার ধসে পড়ছে। বালুমাটি দিয়ে দায়সারাভাবে এ বাঁধগুলো তৈরি করা হয়। ২০১৭ সালে এ বাঁধ ভেঙে নলুয়া হাওরের ফসলডুবির ঘটনা ঘটেছিল। এবারও নলুয়া হাওরের ৬ ও ৭ নম্বর প্রকল্পেও ধস দেখা দিয়েছে।
সোমবার (১১ এপ্রিল) জগন্নাথপুর উপজেলার কৃষকদের সঙ্গে আলাপকালে স্থানীয় একজন কৃষক জাকারিয়া তালুকদার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'প্রতি বছর বাঁধ নির্মাণের জন্য সরকার কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। সব টাকা চলে যায় বড় সাহেবদের পকেটে। হাওরে কাজের কাজ কিছুই হয় না। আমাদের হাওর গেলে বাচ্চাদের নিয়ে চলব কীভাবে? দেশে কী বিচার নেই? প্রতি বছরই অফিসার-নেতারা হাওরের টাকা লুটপাট করবে আর বিচার হবে না, তা আমরা মানতে পারি না। আমাদের চোখের পানি আর হাওরের পানি প্রতি বছর এক হবে? আমাদের কষ্ট কেউ বুঝে না।'
নলুয়া হাওরপারের কৃষক নেতা শহিদুল ইসলাম বলেন, এবার কাজ খুবই নিম্নমানের হওয়াতে এসব দুর্বল বাঁধ বৃষ্টিতে ও সামান্য পানির চাপে ভেঙে যাচ্ছে। ৫ নম্বর প্রকল্পের বাঁধ বারবার ধসে পড়ছে। আমরা স্থানীয় কৃষকদের অর্থ ও স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধটি রক্ষায় কাজ করছি।
১৫ ডিসেম্বর বাঁধের কাজ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও পিআইসি (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) গঠন করা হয় প্রায় এক মাস পর। ফলে হাওরে বিলম্বে বাঁধের কাজ শুরু হওয়ায় নির্ধারিত সময় ২৮ ফেব্রুয়ারি বাঁধের কাজ সমাপ্ত হয়নি। দেরিতে কাজ শুরু হওয়ায় এবং তাড়াহুড়ো করে কাজ করায় অনেক বাঁধে ত্রুটি ও দুর্বল কাজ হয়েছে বলে অভিযোগ কৃষকদের। অন্যদিকে পুরো টাকার কাজ না করে মোটা অংকের লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে রাজনৈতিক নেতা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সহ হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ কাজের সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে।
'হাওর বাঁচাও' আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে কথা বললে, তারাও কৃষকদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে জানান, হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের কাজ এবারও নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি। অনেক জায়গায় অপরিকল্পিত ও অপ্রয়োজনীয় বাঁধের প্রকল্প নিয়ে সরকারি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। সঠিক তদারকির অভাবে কাজে অনিয়ম ও গাফিলতি হয়েছে। এসব অনিয়মের সঙ্গে প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তারা জড়িত বলে তারা দাবি করেন।
'হাওর বাঁচাও' আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের দায়সারা ভাব, দায়িত্বহীনতা এবং প্রকল্পের কমিটির সঙ্গে আর্থিক যোগসাজশে বাঁধের কাজ নিম্নমানের হওয়াতে সামান্য বৃষ্টিতে বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। দ্রুত হাওরের ফসলরক্ষা কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলেও আমরা আন্দোলনে নামব।
ধর্মপাশা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মুনতাসির হাসান বলেন, 'কৃষক মালেক প্রথম উপমন্ত্রীর কাছে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাননি। পরে ওখানে উপস্থিত কয়েকজন যখন বলেছেন, পিআইসি গঠন ইউএনও সাহেব করেন, তখন এসে আমার কথা বলেছেন কৃষক। আমি স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করছি, যেহেতু মন্ত্রীর সামনে অভিযোগ জানিয়েছে, এ বিষয়ে তদন্ত হলে সত্যতা বেরিয়ে আসবে।'
উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হোসেন রোকন বলেন, 'ওই কৃষক মানসিক ভারসাম্যহীন। ওই কথাগুলো কেন বলল, তদন্ত হলে সত্যতা বেরিয়ে আসবে। আমি মনে করি কেউ তাকে এসব কথা শিখিয়ে দিয়েছে। ওই কৃষক এটিও বলেছে, তিন মাস হয় সে দলে যোগদান করেছে। কৃষক মালেক মিথ্যা, ভিত্তিহীন, বানোয়াট অভিযোগ করেছেন।'
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, 'হাওরে বাঁধ ভেঙে ফসল তলিয়ে যাওয়ায় ক্ষয়ক্ষতি এবং পিআইসি গঠনে অনিয়মের অভিযোগ তদন্তের জন্য ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি হয়েছে। এই তদন্ত কমিটি তদন্ত সাপেক্ষে রিপোর্ট দেবার এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের একটি মাত্র বোরো ফসল রক্ষায় আমরা সকলেই একযোগে কাজ করব, সেই আহ্বান জানাচ্ছি।'
টিটি/