মেডিকেলে চান্স পেয়েও অর্থাভাবে অনিশ্চিত মেধাবী সবুজের ভবিষ্যৎ
মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন দরিদ্র পরিবারের সন্তান সবুজ আহমেদ। ভর্তির সুযোগ পেয়ে খুশি হওয়ার কথা থাকলেও দুশ্চিন্তার কালোমেঘে ছেয়ে গেছে সবুজের স্বপ্নের আকাশ। অর্থের অভাবে তার মেডিকেলে ভর্তি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় সন্তানের চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন পূরণে প্রধানমন্ত্রী ও বিত্তবানদের সহযোগিতা কামনা করেছেন সবুজ আহমেদের পরিবার।
সবুজ কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার মরিচা ইউনিয়নের বৈরাগীরচর গ্রামের নতুনচর স্কুলপাড়ার সবজি বিক্রেতা আব্দুর রাজ্জাক সর্দারের ছেলে। সবুজরা এক বোন, ছয় ভাই। সাত ভাইবোনের মধ্যে তিনি পঞ্চম। ছোটবেলা থেকেই সবুজ লেখাপড়ায় মেধার স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছে। সে পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। এসএসসি ও এইচএসসিতেও বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে।
সবুজ এমবিবিএস ভর্তির জন্য রাজশাহী সরকারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে পরীক্ষা দেয়। লিখিত পরীক্ষায় ৭৪ নম্বর সহ সবমিলিয়ে তার প্রাপ্ত নম্বর ২৭৪।
মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পাওয়ায় বন্ধু ও এলাকাবাসীর শুভেচ্ছা ও ভালোবাসায় সিক্ত হলেও অর্থের অভাবে ভর্তি নিয়ে দুশ্চিন্তা তার পিছু ছাড়ছে না।
এদিকে, সজিবের বাবা আব্দুর রাজ্জাক সর্দার গণমাধ্যমকে বলেন, আমি গরিব মানুষ। আমার ছয়টা ছেলে ও একটা মেয়ে। খুব দুঃখ-কষ্টের মধ্যে দিয়ে আমার ছেলে বড় হয়েছে। কখনো খাবার জুটেছে, কখনো জোটেনি। আমি শাক-সবজির ব্যবসা করি। অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যেও সন্তানদের পড়ালেখায় উৎসাহ দিয়েছি। আমি বহু কষ্ট করে ছেলেকে লেখাপড়া করিয়েছি। নদী ভাঙনে আমাদের সব জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। শুধু বাড়ির জমিটা আছে।
তিনি আরও বলেন, আল্লাহর রহমতে আমার ছেলে মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু তাকে ভর্তি করার মতো টাকা-পয়সা আমাদের নেই। আমি চিন্তা করে কোনো কূলকিনারা পাচ্ছি না। কীভাবে ছেলেকে ভর্তি করাব? কীভাবে বই কিনে দিবো? কীভাবে খরচ চালাব? সাহায্যের জন্য আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন করছি।
আপনারা সবাই আমার ছেলের জন্য সাহায্য করুন। আল্লাহ যদি রহমত করে তাহলে আমার ছেলে দেশের মানুষের সেবা করবে। আপনারা যদি সাহায্য করেন তাহলে ছেলেটাকে ডাক্তারি পড়াতে পারবো। তা না হলে আমার কোনো ক্ষমতা নেই তাকে পড়ানোর।
আব্দুর রাজ্জাক সর্দার বলেন, আমি খুব কষ্ট করে ছেলেদের বড় করেছি। বড় ছেলেটা এমএ পাস, মেজোটা বিএ পাস। পরের ছেলেটা ইন্টার পাস। এই ছেলেটা ডাক্তারি লাইনে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। সবার ছোট ছেলেটা অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। প্রধানমন্ত্রী যদি একটু খেয়াল করে আমার ছেলের দিকে, তাহলে আমার ছেলে ডাক্তার হতে পারবে।
সবুজের মা মনজুরা খাতুন বলেন, আমার ছেলে খুব মেধাবী। আমার স্বামী শাক-সবজির ব্যবসা করেন। ছেলেকে পড়াতে গিয়ে অনেক সময় বাজার করতে পারিনি। ছোটবেলা থেকে আমাদের স্বপ্ন ছিলো ছেলেটা ডাক্তার হবে। এখন ছেলে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু টাকার অভাবে তার পড়ালেখা নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটছে আমাদের। ছেলের ভর্তির টেনশনে ঘুম হয় না। আমাদের জীবন খুব কষ্টে পার হচ্ছে। ঘর ছাড়া আমাদের কিছু নেই। এখন ছেলের লেখাপড়া চালানোর ক্ষমতা আমাদের নেই। তাই সরকার ও দেশের মানুষের কাছে সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছি।
স্থানীয়রা বলেন, বৈরাগীরচর গ্রাম ও আশপাশের এলাকায় কোনো ডাক্তার নেই, আমাদের জানা মতে, কেউ চান্সও পায়নি। আমরা চাই সবুজের সাহায্যের জন্য সবাই এগিয়ে আসুক। পড়ালেখা শেষ করে সে একজন ভালো ডাক্তার হোক।
বৈরাগীর চর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলেন, সবুজ অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। কিন্তু তার পরিবার খুব গরিব। ২০১৪ সালে সবুজ আমাদের স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়। সে গরিব হওয়ায় স্কুলের বেতন সম্পূর্ণ ফ্রি করে দিয়েছিলাম। একই সঙ্গে স্কুলের অন্যান্য শিক্ষকদের সার্বিক সহযোগিতা করার জন্য বলেছিলাম। সবাই তাকে সাহায্য করেছে। কেউ কখনো প্রাইভেট পড়ানোর টাকা নিত না। সৌজন্য সংখ্যার বই যেগুলো পেতাম সেগুলো সবুজকে দিয়ে দিতাম। ছোট থেকেই সবুজ খুব বিনয়ী, নম্র ও ভদ্র। তাকে নিয়ে আমাদের অনেক বড় স্বপ্ন ছিলো। সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে, সবুজ মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, অসচ্ছল পরিবারের পক্ষে তাকে পড়াশোনা করানো সম্ভব না। এজন্য আমরাও সবার কাছে সহযোগিতার আবেদন জানাচ্ছি। একইসঙ্গে আমরা তাকে সহযোগিতার চেষ্টা করবো।
মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পাওয়া সবুজ আহমেদ বলেন, আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া। আল্লাহর পর আমি আমার মা-বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। মা-বাবাসহ ভাইদের অবদানের কথা বলে শেষ করার মতো না। তাছাড়া চাচা-চাচি, শিক্ষকদের অবদান অনস্বীকার্য। পরিবার, প্রতিবেশী ও শিক্ষকদের সার্বিক সহযোগিতায় আজ আমি মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় সফল হয়েছি। কিন্তু ভর্তি হওয়ার টাকা আমার পরিবারের নেই। আমার ভর্তি এখন অনিশ্চয়তার মধ্যে। এজন্য সরকার ও দেশের বিত্তবান মানুষের কাছে সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছি।
দৌলতপুর উপজেলার মরিচা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহিদুল ইসলাম জাহিদ বলেন, আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী না হওয়ায় সবুজের বাবা ছেলেকে নিয়ে খুব চিন্তায় আছেন। মেডিকেল কলেজে পড়াশোনার খরচ তার বাবার পক্ষে দেওয়া সম্ভব না।
এ ব্যাপারে দৌলতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আব্দুল জব্বার বলেন, অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল বা অভাবের কথা তারা যদি আমাদের জানান তাহলে সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতার চেষ্টা করা হবে। টাকার অভাবে কোনো মেধাবী শিক্ষার্থীর পড়াশোনা বন্ধ হবে না। অসচ্ছল ও মেধাবী ওই ছাত্রের পড়ালেখার দায়িত্ব সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হবে।
এমএসপি