সিলেটে বাড়ছে ডায়রিয়ার প্রকোপ, ঠাঁই নেই হাসপাতালে
রাত থেকে বমি, এরপর শুরু হয় পাতলা পায়খানা। কয়েক দফায় স্থানীয় ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে সেবন করেন সালমা বেগম। তবুও কাজ হয় না, উল্টো শরীরের দুর্বল লাগা শুরু হয়। নড়াচড়াও করতে পারছিলেন না। অবস্থার অবনতি দেখে ছুটে আসেন হাসপাতালে। কিন্তু শয্যা নেই! শয্যা সংকটের কারণে হাসপাতালের বারান্দায় শুয়েই স্যালাইন নেন তিনি। আর স্যালাইনের প্যাকেট ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন তার ছেলে সিরাজুল ইসলাম।
বৃহস্পতিবার (৭ এপ্রিল) সিলেট ওসমানী হাসপাতালে গিয়ে এমন চিত্রই দেখা গেল।
হাসপাতালটিতে ডায়রিয়ার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বর্তমানে (বৃহস্পতিবার পর্যন্ত) ৩৮ জন। আর সিলেট সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত রোগী ভর্তির সংখ্যা ৩৯ জন। গেল মার্চ মাসে এ হাসপাতালে রোগী ভর্তির সংখ্যা ১১৮ জন থাকলেও চলতি মাসের ৭ তারিখ পর্যন্ত ভর্তির পরিসংখ্যান বলছে- আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। তাছাড়া, সিলেটের বিভিন্ন প্রাইভেট ক্লিনিক ও হাসপাতালেও ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা রয়েছে প্রায় ৩০০ এর ওপরে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতি বছরই গরমকালে ডায়়রিয়ার প্রকোপ দেখা দেয়়। পানিশূন্যতাসহ তাপদাহের কারণে মানুষ অসুস্থ হয়ে ছুটছেন বিভিন্ন হাসপাতালে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে- বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সিলেট বিভাগে ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়েছেন ৭৯ জন। গত বছরের ১ নভেম্বর থেকে এ বছরের ৭ এপ্রিল পর্যন্ত সিলেট বিভাগে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৯১৩ জন।
সম্প্রতি সিলেটের আশপাশের জেলাতেও ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। তবে বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে- পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক রয়েছে।
জানা যায়, এ বছর মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই ডায়়রিয়া রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। মার্চের মাঝামাঝি থেকে ব্যাপকহারে তা বাড়তে শুরু করে।
সাধারণত প্রতি বছর এর প্রকোপ শুরু হয় এপ্রিলের শুরু থেকে এবং ছয় থেকে আট সপ্তাহ ধরে চলতে থাকে। কিন্তু এ বছর ডায়রিয়া যে শুধু আগেভাগেই শুরু হয়েছে তাই নয়, রোগীর সংখ্যাও আগের যেকোনো বছরের চাইতে অনেক বেশি। ডায়রিয়ায় বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন শিশু থেকে বয়স্করা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রমজানের পূর্বে থেকে চলমান তাপদাহের কারণে মানুষের শরীরে পানির চাহিদা বেড়ে যায়। পুকুরের পানি, বৃষ্টির পানি না ফুটিয়ে, ডোবা বা নালা থেকে দূষিত পানি সংগ্রহ, তৃষ্ণা মেটাতে গিয়ে রাস্তার পাশে খোলা জায়গায় লেবুর শরবত ও আখের রস পান করছেন অনেকেই। নোংরা পরিবেশে তৈরি করা এসব পানীয়তে ব্যবহার হচ্ছে দূষিত পানি। ফলে এসব পান করায় ডায়রিয়ার প্রকোপ বেশি বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
রিকাবীবাজারের ব্যবসায়ী জামাল হাসান বলেন, বর্তমানে নগরীতে বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা নির্মাণ চলছে। রাস্তাঘাট খোঁড়া হচ্ছে। সেখানে পানির পাইপ ফেটে গিয়ে সুয়ারেজ লাইনের সঙ্গে মিলে পানি আর বিশুদ্ধ থাকছে না। যার কারণে পানি দূষিত হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে। ফলে সিলেট নগরীতে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
দিরাই ধল এলাকার বাসিন্দা বলেন, ‘আমাদের এলাকায় বিশুদ্ধ টিওবওয়েলের অভাব। তাছাড়া পুকুর-জলাশয় বা নদীর পানিও পানযোগ্য নয়। ফলে সুনামগঞ্জ অঞ্চলে স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে শিশু-নারীসহ বয়স্করা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রচুর গরমের কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকায় এখন ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়েছে।
তারা জানান, ডায়রিয়া প্রতিরোধে নিতে হবে বাড়তি সতর্কতা। বিশেষ করে, খাবার পানির সাথে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় এ সকল এলাকায় ডায়রিয়ার রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সময়মতো চিকিৎসা না দিতে পারলে এটি মারাত্মক হতে পারে। বিশেষ করে, শিশুদের ডায়রিয়া প্রতিরোধে নিতে হবে বাড়তি সতর্কতা। কেননা, বড়দের চেয়ে শিশুদের শরীরের কোষের বাইরের পানি বা এক্সটা সেলুলার ফ্লুইড বেশি থাকে। ফলে, ডায়রিয়া হলে সহজেই তাদের শরীর পানিশূন্য হয়ে পড়ে। পানিশূন্যতা তীব্র হলে শিশু অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। কখনো কিডনি বিকল হতে পারে।
বন্যা ও বর্ষণজনিত রোগ সংক্রান্ত বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের অভিমত, বর্তমান মৌসুমে আমাদের দেশে সাধারণত তিন মাস থেকে ১২ বছরের শিশুরা ডায়রিয়া, কলেরা, জ্বর, নিউমোনিয়া, টাইফয়েড, আমাশয় ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হয়। কারণ একদিকে আবহাওয়ার পরিবর্তন, অন্যদিকে অপ্রত্যাশিত বন্যা ও বর্ষণ। নিম্ন আয়ের পরিবারের লোকদের মধ্যে এ রোগ বেশি হয়ে থাকে। অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতার কারণে গরিব মা-বাবা শিশুদের প্রতি যত্নে দায়িত্বশীল হতে পারেন না। সঠিক সময় চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে পারে না। ফলে মারা যায় অনেক শিশু।
সিলেট সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. ওয়াকিল উদ্দিন বলেন, ডায়রিয়া একটি সাধারণ রোগ। আজকাল ডায়রিয়া বা কলেরায় মৃত্যুর হার খুবই কম। কিন্তু আক্রান্ত হলে মানুষ দুর্বল হয়ে পড়ে, কার্যক্ষমতা কমে যায়। তাই সরকারের পাশাপাশি গণমাধ্যমেরও উচিত ডায়রিয়া প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা। ডায়রিয়া থেকে বাঁচতে বিশুদ্ধ খাবার পানি এবং টাটকা খাবার খেতে হবে। পঁচা ও বাসি খাবার খাওয়া যাবে না। বাজারের খোলা খাবার খাওয়া যাবে না। বৃদ্ধ ও শিশুদের প্রতি বাড়তি মনোযোগ দিতে হবে। এ সময় শিশু ও বৃদ্ধদের আটসাট পোশাক না পরে ঢিলেঢালা পোশাক পরতে হবে। পোশাক সুতির হলে বেশি ভালো হয়। মনে রাখতে হবে, ‘প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিউর’।
সিলেট এমএ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে বর্তমানে ৩৮ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন। এর মধ্যে নতুন করে ভর্তি হয়েছেন ৪ জন। ঢাকা বা অন্যস্থানের তুলনায় আমাদের এখানের অবস্থা স্বাভাবিক।
বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (সিলেট) পরিচালক ডা. হিমাংশু লাল রায় বলেন, স্যালাইন কতোটুকু খেতে হবে তা নির্ভর করবে কতবার পাতলা পায়খানা হচ্ছে বা কতটুকু পানি হারাচ্ছেন তার ওপর। ডায়রিয়ার কারণে একজন মানুষ মাত্র কয়েক ঘণ্টায় এক থেকে দেড় লিটারের বেশি পানি হারাতে পারেন। সহজ কথা হলো, প্রতিবার পায়খানা হওয়ার পর স্যালাইন খাওয়া এবং অল্প করে সারা দিন বারবার খাওয়া। এর বাইরে সারাদিন পানি ও তরল খাবার যেমন-স্যুপ, ডাবের পানি ইত্যাদি খেতে হবে। অনেক সময় ফুড পয়জনিংয়ের কারণে বমি বা পাতলা পায়খানা হয়ে থাকে। মানুষ স্বভাবতই ফার্মেসি থেকে বমি বা পাতলা পায়খানা দ্রুত বন্ধের জন্য ওষুধ খান, যা একেবারেই ঠিক নয়। অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতিত ওষুধ খাওয়া ঠিক না, কারণ পয়জনিংয়ের ক্ষেত্রে বরং কিছু সময় বমি ও পাতলা পায়খানার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ পয়জন বের হয়ে যায়। সব ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়েটিক ওষুধ খাওয়া জরুরি নয়। এক্ষেত্রে প্রয়োজন দেহের লবণ ও পানিশূন্যতা পূরণ করা। দরকার হলে চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খাওয়া যেতে পারে।
এমএসপি