খাদ্য সংকট সুন্দরবনে, বাঘসহ বন্যপ্রাণী লোকালয়ে
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন থেকে বাঘ, হরিণ, অজগর, কুমির ও বন্যশূকর চলে আসছে লোকালয়ে। বন বিভাগ ও সংশ্নিষ্টরা বলেছেন, খাবারের সন্ধান, বন-সংলগ্ন এলাকায় লোকালয় গড়ে ওঠা এবং বন ও লোকালয়ের মধ্যবর্তী নদী-খাল ভরাট হয়ে যাওয়াসহ আরও কয়েকটি কারণে লোকালয়ে আসছে এসব বন্যপ্রাণী। খুলনার সুন্দরবন অ্যাকাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, কিছুদিন পরপর সুন্দরবন থেকে বাঘ, হরিণ, অজগর, কুমির ও বন্যশূকর লোকালয়ে চলে আসছে।
তিনি বলেন, বনে খাবার সংকট ও লোকালয়ে সহজে শিকার ধরতে পারায় বন্যপ্রাণী লোকালয়ে আসছে। বাঘের আক্রমণের শিকার হচ্ছে গরু-মহিষ। মাঝেমধ্যে আতঙ্কিত গ্রামবাসী পিটিয়ে বাঘ হত্যা করে। আবার কখনও কখনও বন বিভাগ তাড়িয়ে কিংবা অচেতন করে বাঘকে বনে ফিরিয়ে দিচ্ছে। একইভাবে হরিণ, অজগর বা কুমির উদ্ধার করে বনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বন্যপ্রাণী লোকালয়ে আসার এই প্রবণতা রোধে বন বিভাগকেই উদ্যোগ নিতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, বনে প্রতিকূলপরিবেশ, পানি এবং মাটিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণেও বন্যপ্রাণী আবাসস্থল ছেড়ে লোকালয়ে আসছে।
খুলনা সার্কেলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দে সাম্প্রতিক সময়ে বাঘসহ সুন্দরবনের অন্যান্য বন্যপ্রাণী লোকালয়ে আসার ঘটনা স্বীকার করে বলেন, বন্যপ্রাণী লোকালয়ে আসা ঠেকাতে বনের ৬০ কিলোমিটার এলাকায় জাল দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, এর আগে ভারতের বন বিভাগ সুন্দরবনে তাদের অংশে জাল দিয়ে সুফল পেয়েছে।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা নির্মল কুমার পাল বন্যপ্রাণী লোকালয়ে আসার কারণ সম্পর্কে বলেন, সুন্দরবন-সংলগ্ন এলাকায় লোকালয় গড়ে উঠেছে। বন ও লোকালয়ের মধ্যবর্তী নদী-খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় বন্যপ্রাণী সহজে লোকালয়ে চলে আসছে। তবে গত ২-৩ বছরে কত সংখ্যক বন্যপ্রাণী লোকালয় থেকে উদ্ধার হয়েছে তার কোনো পরিসংখ্যান জানাতে পারেননি এ বন কর্মকর্তা।
সুন্দরবনের শরণখোলা স্টেশন কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে সুন্দরবন থেকে বাঘ, হরিণ, অজগর, কুমির ও বন্যশূকর লোকালয়ে চলে আসছে। পরে সেগুলো আবার বনে অবমুক্ত করছি আমরা। আসাদুজ্জামান বলেন, শরণখোলা উপজেলার খেজুরবাড়িয়া গ্রামে গত ৫ মে সুন্দরবনের একটি বাঘ চলে আসে। প্রায় একসপ্তাহ বাঘটি লোকালয়ে ঘোরাফেরা করায় আতঙ্কে ছিলেন চার গ্রামের মানুষ। বন ও লোকালয়ের মধ্যবর্তী ভোলা নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় বাঘ অনায়াসে লোকালয়ে চলে আসছে।
এর আগে ২৪ এপ্রিল সুন্দরবনের কাছে ঘাস খাওয়ার সময় শরণখোলার ধানসাগর গ্রামের আফজাল হাওলাদারের একটি গরু বাঘের আক্রমণে গুরুতর জখম হয়। ৩১ মার্চ এ উপজেলার দক্ষিণ রাজাপুর গ্রামের সোবহান হাওলাদারের একটি মহিষ খালেরচরে ঘাস খাওয়ার সময় বন থেকে একটি বাঘ লোকালয়ে এসে মহিষটিকে আক্রমণ করে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, বাঘের আবাসন এলাকায় মানুষের বিচরণ বেড়েছে। সুন্দরবন নির্ভরশীল পেশাজীবীরা বনজসম্পদ আহরণে অবাধে বনে প্রবেশ করছেন। ফলে বাঘও তার স্থান ত্যাগ করছে। তিনি আরও বলেন, বাঘ লোকালয়ে আসার জন্য খাদ্য সংকটও বড় কারণ। এ জন্য একশ্রেণির চোরাশিকারিদের দায়ী করেন তিনি। বাঘ লোকালয়ে ঢুকে পড়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে যেয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট অ্যান্ড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক এ কে ফজলুল হক বলেন, বনের ভেতরে মা বাঘ তার বাচ্চাদের একটা সময় তাড়িয়ে দেয়, তখন ওই বাচ্চার নতুন জায়গা দখলের বিষয় আসে। এক্ষেত্রে বাঘ বন থেকে লোকালয়ে আসতে পারে।
তিনি বলেন, আবার চোরাশিকারিরা বাঘের খাবার হরিণ তো মারছেই। এক্ষেত্রে বনে হরিণের সংখ্যা কমলে বাঘ লোকালয়ে আসবে, এটা অস্বাবিক কিছু নয়। সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক শহিদুল ইসলাম জানান, সুন্দরবনের অন্য তিনটি রেঞ্জের তুলনায় শরণখোলা রেঞ্জে অজগরের সংখ্যা বেশি। গত তিন মাসে সুন্দরবন থেকে লোকালয়ে আসা কমপক্ষে ১০টি অজগর সাপ উদ্ধার করা হয়েছে। সেগুলো আবার বনে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বনেরপাশেই লোকালয় গড়ে উঠেছে। আবার বন ও লোকালয়ের মধ্যবর্তী নদী-খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে আসছে অজগর। শরণখোলার ধানসাগর গ্রামের দোকানি আমিন চৌকিদার বলেন, মাঝে মধ্যে রাতের আধারে বন্যশূকর দলবেঁধে গ্রামে ঢুকে ফসল নষ্ট করছে।
সাম্প্রতিক সময়ে সুন্দরবনের বাঘের লোকালয়ে আসার প্রবনতা বেড়েছে উল্লেখ করে করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবীর বলেন, বাঘের বয়স ১২-১৩ বছর হলে তার শিকারিদাঁত পড়ে যায়। তখন হরিণ বা বন্যশূকর ধরলেও তা শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারে না। তখন খাবারের সন্ধানে মাঝে মধ্যে বন-সংলগ্ন লোকালয়ে চলে যায়। তিনি বলেন, আর বাঘের তাড়া খেয়ে অনেক সময় হরিণ ও বন্যশূকর লোকালয়ে চলে আসে। শূকর কচুর লতি বা এ জাতীয় খাবার পছন্দ করে। ওই খাবারের জন্যও মাঝে মধ্যে লোকালয়ে যায়। গত বছরের ১৮ জুলাই মোংলার জয়মনির ঘোল এলাকা থেকে একটি বন্যশূকর উদ্ধার করেন বনকর্মীরা।
আজাদ কবীর আরও জানান, অজগর সাপ অনেক সময় জোয়ারের পানির সঙ্গে লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। সহজে হাঁস-মুরগি শিকার করে খেতেও লোকালয়ে যায়। এর মধ্যেই সুন্দরবন থেকে লোকালয়ে আসা কয়েকটি অজগর উদ্ধার হয়েছে। আর বন-সংলগ্ন খাল দিয়ে লোকালয়ের পুকুর বা ঘেরে যায় কুমির। চলতি বছরের ১৯ মার্চ রামপাল উপজেলার গৌরম্ভা গ্রামের পুকুর থেকে একটি কুমির উদ্ধার হয়েছিল।
এর আগে ১২ এপ্রিল মোংলার বুড়িরডাঙ্গা গ্রামের একটি চিংড়িঘের থেকে উদ্ধার হয় আরও একটি কুমির। পশুর নদ থেকে খাল দিয়ে কুমির চিংড়ি ঘেরে চলে আসে বলে ধারণা তার। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার শোভনা এলাকার ভদ্রা নদীতে কুমির আতঙ্কে রয়েছে এলাকাবাসী। গত ৮ জুলাই ভদ্রা নদী সংলগ্ন মঠবাড়িয়া গ্রামের জেলে মহিতোষ নদীতে মাছ ধরতে গেলে একটি কুমির তার নৌকায় হামলা করে। পরে মহিতোষ ও তার সহযোগীরা জাল ফেলে দ্রুত কিনারে চলে আসেন।
এছাড়া জিয়ালতলা এলাকার ভদ্রানদীর তীর থেকে কুমির একটি ছাগল নিয়ে গেছে বলে এলাকাবাসীর ভাষ্য। ডুমুরিয়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আবুবকর সিদ্দিক এ ঘটনা স্বীকার করে বলেন, ভদ্রা নদীটি শিবসা নদীর সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে সাগরে পড়েছে। ফলে সাগর থেকে দলছুট হয়ে কুমির শাখা নদীতে প্রবেশ করেছে বলে ধারণা তার।
এএজেড