আয়কর দিতে, সনদ নিতে দিতে হয় ঘুষ!
বরগুনা উপ কর কমিশনারের কার্যালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের বিরুদ্ধে সেবাগ্রহিতাদের জিম্মি করে ঘুষ আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। একাধিক সেবা গ্রহিতার অভিযোগ, ই টিআইন নিবন্ধন, আয়কর রিটার্ন প্রতিবেদন, টিআইএন সনদ প্রতিটি ক্ষেত্রেই অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারিরা ঘুষ দাবি করেন। ঘুষ না দেয়া পর্যন্ত কোনো কাজই হয়না। এছাড়া কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকদের বিরুদ্ধে 'এ্যকশানে' যাওয়ার ভয় দেখিয়ে ঘুষ আদায়ের অভিযোগ উঠেছে।
সেবা গ্রহিতাদের অভিযোগের ভিত্তিতে সরেজমিনে বরগুনা উপ কর কমিশনারের কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায় অফিসের ঢোকার মুখে চেয়ার টেবিলে বসে আয়কর জমা দিতে আসা ব্যক্তিদের কাগজপত্র যাচাই করছেন এ ব্যক্তি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইনি আয়কর অফিসের নোটিশ সার্ভার মোয়াজ্জেম হোসেন।
আয়কর সংক্রান্ত নোটিশ পৌঁছে দেয়া মোয়াজ্জেম হোসেনের কাজ। কিন্ত তিনি ডেস্কে বসে কাগজপত্রের নানা খুঁত বের করে অযুহাতে দাবি করছেন ঘুষ। আর প্রকাশ্যেই এই সেবা গ্রহিতাদের কাছ থেকে প্রকাশ্যে ঘুষ গ্রহন করছেন। কথা বলতে চাইলে 'স্যারের সাথে কথা বলেন' বলেই অফিস থেকে সটকে পড়েন মোয়াজ্জেম হোসেন। একই অভিযোগ অফিস সহকারি নিয়াজ মোর্শেদের বিরুদ্ধেও।
আয়কর রিটার্ন দিতে আসা বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার সদর ইউনিয়নের ব্যবসায়ী সাফায়াত হোসেন বলেন, আমি আয়কর রিটার্ন জমা দিতে আসার পর ডেস্কে বসা ওই ব্যক্তি (মোয়াজ্জেম হোসেন) আমার কাগজপত্র নিয়ে যাচাই বাছাই করে। এরপর নানা খুঁত বের করে ঠিক করে দেয়ার জন্য এক হাজার টাকা দাবি করেন। আমি টাকা দিতে অস্বীকার করি এবং কাগজপত্র ফেরত আনি।
তিনি আমাকে অফিস সহকারির টেবিলে যেতে বলেন। আমি অফিস সহকারি নিয়াজ মোর্শেদের কাছে আয়কর রিটার্ন জমা দিতে গেলে তিনিও একইভাবে খুঁত বের করে কাগজ ফিরিয়ে দেন। পরে সেখানে আয়কর দিতে আসা আরেক ব্যক্তি আমাকে বলেন, ভাই টাকা না দিলে এখানে আপনার কাজ হবেনা। বাধ্য হয়ে আমি অফিস সহকারিকে ১০০০ টাকা দিয়ে আয়কর রিটার্ন জমা দেই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বরগুনা সদরের বেশ কয়েকজন ঠিকাদার জানান, আয়কর জমা দিতে গিয়েও ঘুষ দিতে হয় আবার সনদ নিতে হলেও তিন থেকে পাঁচ হাজার পর্যন্ত টাকা দিতেই হয়। টাকা না দিয়ে ট্যাক্স অফিস থেকে কেউই সনদ পায়না।
শহরের চরকলোনী এলাকার বাসিন্দা মারুফ মৃধা বলেন, আয়কর অফিসের কর্মচারিদের ঘুষ নিয়ে সেই টাকা কর কর্মকর্তাসহ অন্যদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়। এটা প্রকাশ্যেই ঘটে এবং আপনি অফিসে গেলেই দেখতে পাবেন ফাইলের সাথে টাকা দিলেই কাজ হয়। টাকা না দিলে ওই ফাইলের আর কাজ হয়না।
আবুল কালাম আজাদ নামে বরগুনা শহরের এক ব্যবসায়ী বলেন, আয়কর রিটার্ন জমা দেয়া ও সনদ পাওয়া বাবদ কর পরিদর্শক আবদুর রহিম আমার কাছ থেকে ১২ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছেন।
একই অভিযোগ শহরের সদর সড়কের সাতক্ষিরা দধিঘরের উত্তম কুমারের। তিনি বলেন, আয়কর জমা দিয়ে সনদ নিতে আমি তিন হাজার টাকা কর্মকর্তাকে ঘুষ দিয়েছি। এছাড়ও মিস্টি ব্যবসায়ী আতাহার মিয়া বলেন, সব কাগজপত্র ঠিক থাকার পরে আমি ৫ হাজার টাকা দিয়ে আয়কর সনদ নিয়েছি।
শুধু ব্যবসায়ী নন, সরকারি কর্মকর্তাদের জিম্মি করে আয়করের নামের ঘুষ আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী (ওজোপাডিকো) বরগুনা কার্যালয়েও নির্বাহী প্রকৌশলী অতিব বিশ্বাস বলেন, অনলাইনে আয়কর দেয়ার সুযোগ থাকলেও এখানে অনলাইনে টাকা জমা দেয়ার সুযোগ নেই, ফলে আয়কর রিটার্ন জমা দিতে গিয়ে হয়রাণির শিকার হতে হয় এবং এক পর্যায়ে ঘুষ দিতে বাধ্য হতে হয়। একই অভিযোগ উপ সহকারি প্রকৌশলী মহিউদ্দীন আহমেদেরও।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) বরগুনার সভাপতি মনির হোসেন কামাল বলে, এটা খুবই দুঃখজনক ব্যপার। আমাদের কাছেও আয়কর অফিসের ঘুষের ব্যপারে অভিযোগ আসছে। ট্যাক্স দিতে গিয়ে যদি ঘুষ বিরম্বনার শিকার হতে হয় তবে আয়কর দেয়ার প্রতি অনিহা সৃষ্টি হবে এবং রাজস্ব আদায় কম হবে। আমরা সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানাবো যাতে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে আয়কর আদায় ও সনদ দেয়া হয়।
এ বিষয়ে সহকারি কর কমিশনার মো. কামরুজ্জমান সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি ঘুষ নেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন। পরে ঘুষ নেয়ার ছবি ও ভিডিও চিত্র দেখানো হলে তিনি বলেন, আমি আমার অফিস কক্ষে থেকে কাজ করি। বাইরে কারা কি করে সেটা তো দেখছিনা। তবে কেউ যদি ঘুষ নিয়ে থাকে আমি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।
এএজেড