আকাশ সংস্কৃতির দাপটে জৌলুশ হারাচ্ছে ‘ধামের গান’
সনাতন ধর্মালম্বীদের লক্ষ্মীপূজা ও কালীপূজাকে কেন্দ্র করে ঠাকুরগাঁওয়ের বিভিন্ন এলাকায় শুরু হয়েছে ঐতিহ্যবাহী ধামের গান। সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের সাধারণ ঘটনা রঙ্গরসের মাধ্যমে পরিবেশনার কারণে ধামের গান উত্তরাঞ্চলের সব শ্রেণির মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয়। অনেকটা সৌখিনতার স্বাদে জমকালো ভাবেই আয়োজন হয় এই ধামের গান উৎসব।
রঙ-বেরঙের কাপড় টাঙিয়ে ও মাটির উঁচু ঢিবির চারপাশে বাঁশের ঘের দিয়ে বানানো হয় মঞ্চ। সেখানে রাতভর অভিনয় সহকারে গান গাওয়া হয়। দৈনন্দিন জীবনযাপনের নানা উপকরণ নিয়েই গল্প ও গান তৈরি হয়। প্রান্তিক কিংবা সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, সাংসারিক জটিলতা, প্রেম, পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের অবহেলা, দুশ্চরিত্রের লাম্পট্যসহ যাবতীয় বিষয়াদি অত্যন্ত সহজভাবে উঠে আসে এসব গানে। জটিল বিষয়গুলোকেও হাস্যরসের মাধ্যমে চিত্তাকর্ষক করে তোলা হয় অভিনয়ের মাধ্যমে।
স্থানীয়দের দাবি, আকাশ-সংস্কৃতির প্রভাব আর তেমন অর্থকড়ি না থাকায় এখন আর আনাগোনা নেই ধামের দলের, আসরও জমে না তেমন। তবে জেলা প্রশাসনের আশ্বাস, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ধামের গানের স্বীকৃতি ও প্রসারের জন্য চেষ্টা করা হবে।
আকাশ সংস্কৃতি ও স্মার্ট ফোনের যুগে আগের মতো চাহিদা না থাকায় দিন দিন জৌলুস হারাতে বসেছে ঠাকুরগাঁওয়ের এক সময়ের তুমুল জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী এই লোকনাট্য সংগীত। সাধারণত শীতের আগমনী থেকে শুরু হয়ে সারা শীত মৌসুমজুড়ে ধামের গানের আসর বসে জেলার বিভিন্ন এলাকায়।
ধামের গানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ও বয়োবৃদ্ধদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঠাকুরগাঁওয়ের স্থানীয় লোকনাট্যই ‘ধামের গান’ নামে পরিচিত। একে অঞ্চল ভেদে সোরীগান বলেও চিহ্নিত করা হয়। ধামের আভিধানিক অর্থ গৃহ বা স্থান। কারো কারো মতে, স্থানীয় ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে যে স্থানে পুণ্যার্থীদের সমাগম হয় তাকেও ধাম বলে। এই ধামে উৎসবের আনন্দ ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশে যে সাংস্কৃতিক আয়োজন বা পরিবেশনা তাই মূলত ধামের গান।
অন্যান্য লোকনাট্যের মতো ধামের গানেও নৃত্য, গীত ও অভিনয়ের মাধ্যমে একটি কাহিনী ফুটিয়ে তোলা হয়। তবে আসরে বসেই ঠাকুরগাঁওয়ের আঞ্চলিক ভাষায় তাৎক্ষণিকভাবে এ গান রচিত ও পরিবেশন করেন ধামের গানের শিল্পীরা।
এই গানের ধারার প্রচলনের সঠিক তথ্য জানা যায়নি। তবে ৯০ বছর বয়সী প্রবীণ ধামের গানের শিল্পী সদর উপজেলার আকচা ইউনিয়নের পালপাড়া গ্রামের মাহিন্দ চন্দ্র পাল জানায়, এই গানের কথা তিনি তার বাবা-দাদার কাছে শুনেছেন। ২০ বছর বয়স থেকেই তিনি এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। শুরুর দিকে আসর থেকে তিনি পারিশ্রমিক হিসেবে কমিটির কাছ থেকে পেতেন ৩০/৪০ টাকা। বয়সের কারণে বর্তমানে আর গান করা হয়ে ওঠে না। তবে বাড়ির আশপাশে ধামের আসর বসলে ছুটে যান তিনি।
ধামের গানের দল পুরুষকেন্দ্রিক হয়ে থাকে। প্রতিটি দলে ১২ থেকে ২৫ জন সদস্য থাকেন। চরিত্র অনুযায়ী পুরুষরাই নারী সেজে অভিনয় করেন। সাধারণত শীতের দিনে বিকাল বা সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত অবধি চলে এই গান-অভিয়নের আসর। নানা ঢংয়ে গান ও সেই সঙ্গে অভিনয় করে দর্শকদের মন জয়ের চেষ্টা করেন দলের সদস্যরা। তবে ধামের দলের সদস্যরা পুরুষ হলেও এই অঞ্চলের নারীদের মধ্যেই ধামের গানের জনপ্রিয়তা বেশি। তাই সংসারের কাজকর্ম সামলে সন্ধ্যার আগেই আসরে এসে বসেন গ্রামের কিশোরী-তরুণী ও গৃহবধূরা। বাদ যান না বাড়ির বৃদ্ধারাও।
ধামের গানের শিল্পী জয়ন্ত পাল ও প্রেমা পাল জানান, এটা তাদের পূর্ণ পেশা নয়। গ্রামাঞ্চলের মানুষকে বিনোদন দিতেই ধামের গানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন তারা।
এদিকে আকচা ইউনিয়নের বলদিয়া ধামের দলের সঙ্গে আসা এক অভিনেতা শুকুল পাল জানান, কয়েক বছর ধরে ধামের গান করে আসছেন। কিন্তু আগের মতো আর এর কদর নেই। আসরও জমছে না।
তার দলে ১৭ জন সদস্য রয়েছে জানিয়ে তিনি আরও জানান, কর্মীদের তেমন পারিশ্রমিকও দিতে পারেন না এখন। এক পালা থেকে অন্য পালায় যাচ্ছেন ঠিকই কিন্তু কোনও মতো খরচ উঠে আসছে শুধু।
জানা গেছে, ধামের আসরগুলোতে শিল্পীদের বসার তেমন ব্যবস্থা নেই। থাকে না আলোকসজ্জাও। খোলা আকাশের নিচে বসেই প্রস্তুতি নিয়ে যেতে হয় অভিনয় মঞ্চে। অর্থের যোগান না থাকায় শিল্পীদেরও উপযুক্ত সম্মানী দিতে পারেন না আয়োজকরা। তবু সামান্য পারিশ্রমিকেই শিল্পীরা খুশি মনে করে যান ধামের গান।
এমন পরিস্থিতির মধ্যেও বিগত কয়েক বছর ধরে ধামের গানের আয়োজন করে আসছেন সদর উপজেলার আকচা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সুব্রত কুমার বর্মণ। তিনি ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, এ ধরনের উদ্যোগে অর্থের প্রয়োজন হয়। স্থানীয়ভাবে অর্থ সংগ্রহ করে এর আয়োজন করে থাকেন। তার ইউনিয়নের বেশ-কয়েকটি স্থানে এখন ধামের গানের আসর চলছে। এ অঞ্চলের গ্রামীণ লোক সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান অনুষজ্ঞ ও ঐতিহ্যবাহী। এ ধামের গান ধরে রাখতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন বলে জানান তিনি।
এ ব্যাপারে জেলা কালচারাল কর্মকর্তা সৈয়দ জাকির হোসেন ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘ধামের গান’ উত্তরাঞ্চলের সব শ্রেণির মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয়। সাধারণত শরৎ-হেমন্তকালে ধামের গানের আসর বসে। লক্ষ্মীপূজার পরের তিথি থেকে শুরু হয়ে চলে কালীপূজা পর্যন্ত। আকাশ সংস্কৃতির দাপটে গ্রামবাংলার জনপদ মাতানো এই সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে বসেছে। ধামের গানের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে জেলা শিল্পকলা একাডেমির পাশাপাশি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো: মাহাবুবুর রহমান বলেন, ধামের গানের ঐতিহ্য ধরে রাখতে জেলা শিল্পকলা একাডেমি ভূমিকা রাখবে এবং সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এ গানকে অন্যান্য জেলায় ছড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি জাতীয় গান হিসেবে স্বীকৃতির জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে।
এসআইএইচ