পাঁচ শর্তে রোহিঙ্গারা মিয়ানমার ফিরতে চায়
স্বদেশে ফিরে মুক্ত জীবন কাটাতে চায় রোহিঙ্গারা। তারা শরনার্থী জীবন ত্যাগ করে নিজের দেশে গিয়ে সুন্দর একটি জীবন সাজাতে চায়৷ রোহিঙ্গাদের দাবি মিয়ানমার তাদের সব কিছু কেড়ে নিলেও শান্তি আর নিরাপত্তার আশ্বাস পেলে ফিরে যেতে চান তারা। মিয়ানমারে ফিরতে পাঁচটি দাবির বাস্তবায়ন চান রোহিঙ্গারা।
সেগুলো হচ্ছে- রোহিঙ্গারা আরাকানের স্থানীয় আদিবাসী। সে জন্য তাদের ন্যাটিভ স্ট্যাটাস বা স্থানীয় মর্যাদা সংসদে আইন করে পুনর্বহাল করতে হবে, যার আন্তর্জাতিক গ্যারান্টি থাকতে হবে। আরাকান রাজ্যে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের সিটিজেন কার্ড দিতে হবে। বাংলাদেশের ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরও সিটিজেনশিপ কার্ড দিয়ে প্রত্যাবাসন করে স্থানীয় নাগরিক মর্যাদা দিতে হবে। একই সঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় থাকা রোহিঙ্গাদের সিটিজেনশিপ কার্ড দিয়ে স্থানীয় নাগরিক মর্যাদা দিতে হবে।
রোহিঙ্গাদের তাদের নিজস্ব গ্রামে ফিরিয়ে নিতে হবে এবং তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া জমিজমা যথাযথ ক্ষতিপূরণসহ ফেরত দিতে হবে। আরাকানে রোহিঙ্গাদের জীবন ও সম্পদ রক্ষার জন্য রোহিঙ্গা পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করতে হবে। বার্মার স্থানীয় আদালতের পরিবর্তে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বা আইসিসির মতো কোনো ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনালে অপরাধীদের বিচার করতে হবে।
টেকনাফের উনছিপ্রাং ২২ নং ক্যাম্পের মাঝি রফিক বলেন, আমরা আর বাংলাদেশে থাকতে চাই না। আমরা আমাদের দেশে ফিরতে চাই। আর বন্দি জীবন কাটাতে চাই না। বাংলাদেশ সরকার আমাদের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ করেছে। এই দেশের মানুষ আমাদের প্রতি যে ভালোবাসা দেখিয়েছেন, সেটি কোনোদিন ভুলতে পারবো না। তবে আমাদের প্রত্যাবাসন টেকাতে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র চলছে। আমরা বিশ্ব নেতাদের সহযোগিতা কামনা করি।
উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পের হেড মাঝি আমিন বলেন, আমাদের পাঁচটি দাবি পূরণ করলে আমরা দেশে ফিরবো। আমরা আর কাঁটাতারের মধ্যে বন্দি হয়ে থাকতে চাই না। আমরাও তো মানুষ। আমরা বাংলাদেশে থাকতে আসেনি। আমরাও বুঝতে পারছি বাংলাদেশের অবস্থা। রোহিঙ্গারা বললেন, একজন দুই জন করে নয় পরিবার নিয়ে স্বদেশে ফিরতে চান তারা। যেখানে নাগরিক হিসেবে সব অধিকার থাকবে।
উখিয়া বালুখালী ১১নং ক্যাম্পের বাসিন্দা করিম উল্লাহ বলেন, আমাদের পরিবারের ১৮ জন সদস্য আছি। যেভাবেই ভাসনচরে নিয়ে গেছে, আমরা সেভাবে যাব না। একবারে আমাদের পুরো পরিবারকে নিয়ে মিয়ানমার ফিরব।
হাবিবউল্লাহ নামে আরেক রোহিঙ্গা বলেন, আমরা দেশে ফিরতে রাজি তবে, আমাদের দাবিগুলো মেনে নিতে হবে। দেশে ফেরার আগে আমাদের নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা, বাড়িঘর জমি ফেরত পাবার নিশ্চয়তা দিতে হবে। না হয় আমরা আবারো নির্যাতনের শিকার হব। আমাদের যদি জমি, জাতীয়তা না দেয় তাহলে আমরা কী আশা নিয়ে ফিরব? তাই আমাদের আগে পাঁচ দফা দাবি পূরণ করতে হবে।
আরাকান রোহিঙ্গা হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস সোসাইটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জুবাইর বলেন, রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরত পাঠাতে চীনের উদ্যোগ আশা জাগায়নি। অধিকার নিশ্চিত হলে দেশে ফিরতে প্রস্তুত তারা। তবে বর্তমান যুদ্ধের মাঝে ফিরে যাওয়া অনিরাপদ। এই মুহূর্তে মিয়ানমার খুব উত্তপ্ত। এখন আমাদের দেশে ফিরা পুরোপুরি অনিরাপদ। স্থানীয়রা জানান, রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরত যাওয়া খুবই জরুরি। নয়তো বড় বিপদে পড়বে এই অঞ্চল।
উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়নের কুতুপালংয়ের ইউপি সদস্য হেলাল উদ্দিন বলেন, রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয়রা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত। রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয়রা ফসলি জমি, শ্রমবাজার সব কিছু হারিয়েছে। যেভাবে মাদক ও অস্ত্র পাচার বৃদ্ধি পেয়েছে যদি দ্রুত প্রত্যাবাসন না হয় তাহলে স্থানীয়দের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরত পাঠাতে চীনের উদ্যোগ দ্রুত বাস্তবায়ন করা হোক।
কক্সবাজার নাগরিক আন্দোলনের সদস্য সচিব এইচ এম নজরুল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গারা শুধু কক্সবাজারের জন্য অভিশাপ নয়, পুরো দেশের জন্য ঝুঁকি। আমরা শুরু থেকে রোহিঙ্গাদের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আসছি। সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার ফিরিয়ে নিতে সম্মতি জানিয়েছে।
বিষয়টি আমাদের জন্য ঈদের আনন্দের মতো হলেও কালোছায়া এখনো আমাদের ঘিরে রেখেছে। কারণ এনজিওগুলো রোহিঙ্গারা ফিরে যাক সেটি কখনো চায়নি। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরুর প্রস্তুতি নেওয়ার আগে দেশি-বিদেশি এনজিওগুলোর প্রতি প্রশাসনের নজরদারি বাড়াতে হবে। এবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে আমরা কিছুটা আশাবাদী হওয়ার কারণ হচ্ছে চীনের মধ্যস্থতা। চীন যদি সত্যি সত্যি চায় বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন, তাহলে কেবল রোহিঙ্গামুক্ত হবে বাংলাদেশ।
শরণার্থী বিষয়ক কমিশন বলছে, ৮ লাখেরও বেশি তালিকা থেকে এ পর্যন্ত মাত্র ৬০ হাজারের মতো রোহিঙ্গাকে নিজ দেশের বাসিন্দা হিসেবে বাছাই করছে মিয়ানমার।
শরণার্থী ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান বলেন, আমরা রোহিঙ্গাদের তালিকা করে প্রধানমন্ত্রী বরাবর পাঠিয়েছি অনেক আগে। ৮ লাখেরও বেশি তালিকা থেকে এ পর্যন্ত মাত্র ৬০ হাজারের মতো রোহিঙ্গাকে নিজ দেশের বাসিন্দা হিসেবে বাছাই করেছে মিয়ানমার। আমরা সবসময়ই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য প্রস্তুত।
এএজেড