সিলেটে নিয়ন্ত্রণহীন মোটরসাইকেল, বাড়ছে দুর্ঘটনা
সড়কে মোটরসাইকেল একটি আতঙ্কের নাম। সম্প্রতি উদ্বেগজনকহারে বাড়ছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। সিলেটে চলতি মাসের শুরুতেই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৬ জন।
এর মধ্যে ১ এপ্রিল ঢাকার মানিকগঞ্জ থেকে মোটরসাইকেলযোগে সিলেটে বেড়াতে আসার সময় দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান দুই বন্ধু। হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার বেলঘর এলাকায় সিলেটগামী মোটরসাইকেলটির সঙ্গে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি পিকআপ ভ্যানের সংঘর্ষ হলে জামি ও রাজিব নামের এই দুই বন্ধুর মৃত্যু হয়। ৬ এপ্রিল সিলেটের জৈন্তাপুরে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় শিশুসহ প্রাণ হারান আরও তিনজন। এই দুর্ঘটনায় আহত হওয়া অপর এক ব্যক্তি ১১ এপ্রিল চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
সড়কে ১৯ ধরনের যানবাহন চলাচল করলেও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর বিষয়টি এখন উদ্বেগের কারণ। অন্যান্য যানবাহনের চেয়ে সড়কে এই যান যেমন বেশি নামছে তেমনি দুর্ঘটনায় পড়ে এর চালক ও আরোহীদের মৃতের সংখ্যাও সবচেয়ে বেশি। মোটরবাইক চালানোর যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকা ও উঠতি বয়সের তরুণরা বেপরোয়া গতিতে চালানোর কারণেই এই মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সম্প্রতী এ দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে, তা রীতিমতো আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে।
সিলেট হাইওয়ে পুলিশের তথ্য অনুযায়ী কেবল ২০২১ সালে সিলেট অঞ্চলে যানবাহনের মামলা হয়েছে ১৪ হাজার ৯৯৫ টি। এরমধ্যে গতি নিয়ন্ত্রণ না মানায় ৪ হাজার ৯৬৪টি, গাড়ির কাগজ পত্রের বৈধতা না থাকায় ৮ হাজার ৭৫৭টি ও মোটরযানের মামলা রয়েছে ১ হাজার ২০৯টি। মোটরসাইকেলের মামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে সড়কে গতি নিয়ন্ত্রণ, হ্যালমেট ব্যবহার না করা, গাড়ির রেজিস্ট্রেশনসহ বিভিন্ন মামলা। গেল বছর যানবাহনের মামলাখাতে সরকারি কোষাগারে জমা হয়েছে ৪ কোটি ৫ লাখ ৫০ হাজার ৫০০ টাকা।
এদিকে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সিলেট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সাল পর্যন্ত সিলেটে নিবন্ধিত মোট মোটরসাইকেলের সংখ্যা ছিল ৮ হাজার ৫৯টি। এর পরের বছরে তা দাঁড়ায় ৬ হাজার ৮৪৬টি। ২০২১ সালে মোটরসাইকেল নিবন্ধন ছিল ৮ হাজার ৯৩৪টি এবং চলতি বছরের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত এ তিন মাসেই মোট মোটরসাইকেল নিবন্ধনের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ হাজার ৩১২টিতে। তবে সড়কে নিবন্ধনের বাইরেও অনেক মোটরবাইক চলাচল করছে। অনিবন্ধিত মোটরসাইকলের সংখ্যা ২৭ হাজারের উপরে হতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
সিলেটে বছরখানেক ধরে ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালান সুনামগঞ্জের আরফান। আয়ও বেশ হচ্ছে। প্রতিদিন তেলের খরচ বাদ দিয়ে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা আয় হচ্ছে। উপশহর পয়েন্ট, বন্দরবাজার ও হুমায়ুন চত্বর মোড়ে তপ্ত রোদে দাঁড়িয়ে যাত্রীর অপেক্ষা করছিলেন। হাতে ১ হাজার ৫০০ টাকা দামের একটি হেলমেট। আর যাত্রীর জন্য ২৫০ টাকা দামের প্লাস্টিকের আরেকটি হেলমেট সিটের ওপর রেখে দিয়েছেন। তার কাছে মোটরসাইকেলে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর তথ্য উল্লেখ করলে মুখটা মুহূর্তেই মলিন হয়ে যায়। কেন বাড়ছে?- প্রশ্ন করতেই উত্তরে বলেন, ‘ওভার স্পিডে গাড়ি চালানোর জন্যই দুর্ঘটনা ঘটে। অনেক বাইকার আছে, এমন জোরে টান দেয়, তখন যদি সামনে গাড়ি পড়ে যায় আর কন্ট্রোল করা যায় না। আবার ওভার স্পিডে গাড়ি ওভারটেক করার সময় সামনাসামনি গাড়ি চলে এলে মৃত্যু নিশ্চিত।’
পাশেই মোটরসাইকেল নিয়ে অপেক্ষমান বাইকার আবদুর রউফ। বাড়ি সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে। তিনি এগিয়ে এসে সড়ক দুর্ঘটনার দোষ কিছুটা নিজের দিকে নিয়ে বলেন, ‘আমাদের উচিত ধীরে-সুস্থে গাড়ি চালানো। বিশেষ করে হাইওয়েতে ফুল স্পিডে যখন চালানো হয় তখন সামান্য ভুলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এ জন্য আমাদেরই নিরাপদে চলতে হবে।’
নগরীর বিভিন্ন মোটরসাইকেল চালক ও মোটরপার্টস বিক্রেতারা জানালেন, দেশের মার্কেটে যে হেলমেট পাওয়া যায় তা দুর্ঘটনা রোধ করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। বেশিরভাগ চালকই মামলার হাত থেকে বাঁচতে ২৫০ টাকা থেকে শুরু করে ২ হাজার টাকা দামের হেলমেট পরেন, যা দুর্ঘটনা থেকে খুব একটা সুরক্ষা দেয় না। আর মার্কেটে যেসব হেলমেট পাওয়া যায় তা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) মাধ্যমে পরীক্ষিত নয়। এমনকি এ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে হেলমেটের মান যাচাই ও নির্ধারণ করে দেওয়ার সক্ষমতা নেই। এতে যেমন-তেমন হেলমেট পরেন চালকরা, ফলে দুর্ঘটনা ঘটলে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ধাবিত হতে হয় চালক ও তার সঙ্গীকে। নগরীর বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে অনেক চালক মাথায় হেলমেট পরেন না, এতে মৃত্যুঝুঁকি কয়েকগুণ পর্যন্ত বেড়ে গেছে।
বেপরোয়া চালানো, অনিরাপদ ওভারটেক ও তরুণদের রেসিং করার কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে। দুর্ঘটনা ও মৃত্যু কমাতে চালক ও অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে বলে মনে করেন নিসচা কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সাংগঠনিক সম্পাদক ও সদস্য সচিব চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগীয় কমিটির জহিরুল ইসলাম মিশু। তিনি বলেন, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হচ্ছে ওভারস্পিডিং ও অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে চালানো। লাইসেন্স বিহীন চালক ও হেলমেট পরিধান না করার কারণে দুর্ঘটনার পর মৃত্যুর হার বেশি দেখা যায়।
তিনি বলেন, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা রোধ করার জন্য আইনের কঠোর প্রয়োগ ও মনিটরিং দরকার। নতুন বাইক ক্রয়ের সময় ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করতে হবে।
বিআরটিএ সিলেটের সহকারি পরিচালক সানাউল হক বলেন, বর্তমানে ট্যাক্স, নিবন্ধন ফি অনেক কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে মোটরসাইকেল সহজলভ্য হয়ে গেছে। যারা একসময় কৃষিকাজ করতেন তারাও জীবিকার তাগিদে কিছু টাকা জমিয়ে মোটরসাইকেল কিনেছেন। কিন্তু তাদের মোটরসাইকেল চালানোর জন্য যে অভিজ্ঞতা দরকার তার কিছুই নেই। অনেকেই ভালো কোনো ট্রেনারের কাছে প্রশিক্ষণ না নিয়েই বাইক কিনে গ্রামে নিয়ে যাচ্ছেন এবং ট্রিপ দিচ্ছেন। গণপরিবহন হিসেবে ব্যবহার করছে। এতে দুর্ঘটনা বাড়ছে। তরুণরা দলে দলে মহাসড়কে রেসিং করছে। কোনো নিয়মকানুন মানছে না। কমদামি হেলমেট পরেন চালকরা। এক্ষেত্রে বিএসটিআইয়ের একটি নীতিমালা আছে, সেই নিয়ম অনুযায়ী হেলমেট আমদানি বা দেশে তৈরি করার কথা। কিন্তু এর মনিটরিং করার কোনো ব্যবস্থা দেশে নেই। এ জন্য একটি টেস্টিং ল্যাব তৈরি করতে হবে। আইন সঠিকভাবে প্রয়োগ করে, রেসিং, ওভার স্পিড নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এক্সপ্রেস ওয়ে যেখানে হচ্ছে সেখানে ওভার স্পিডিং রোধ করতে হবে। তরুণ ও অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। বয়স হয়নি; কিন্তু পরীক্ষায় পাস করেছে এ জন্য বাইক কিনে দিচ্ছেন! এটা ঠিক নয়, যা ক্যানসারের সেলের মতো দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। এ জন্য সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুর্ঘটনা বাড়ছে।
হাইওয়ে পুলিশ সুপার (সিলেট রিজিয়ন) মো. শহীদুল্লাহ বলেন, মোটরসাইকেল নিয়ে আমাদের সমাজে একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত সমাজের অভিভাবক নিজ সন্তানদের প্রশিক্ষণ গ্রহণের আগেই হাতে মোটরবাইক তুলে দিচ্ছেন।
তিনি বলেন, আগের চেয়ে অনেকটাই সহজলভ্য হয়ে গেছে এই যানটি। অপরদিকে করোনার ধাক্কায় অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। এতে কোনোভাবে একটি বাইক কিনে দেশের যেকোনো স্থানে রাইড শেয়ার করে আয় করছেন। কিন্তু গাড়ি চালাতে তাদের যে প্রশিক্ষণের দরকার তা তারা নেন না। কমপক্ষে ১ হাজার কিলোমিটার পথ চালানোর পর হাইওয়ে বা মহাসড়কে উঠতে হয়। কিন্তু এই নিয়ম অনেক চালকই মানছেন না। বাইক কেনার পরই মহাসড়কে চালানো শুরু করেন, এতে দুর্ঘটনার শিকার হন। অপরদিকে বেপরোয়া চালানো ও তরুণরা রেসিং করার কারণেও দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন।
টিটি/