এলাকায় ‘দানবীর’, পুলিশ বলছে ‘পেশাদার চোর’
দীর্ঘ ১১ বছর ধরে শানু হাওলাদার (৫৫) পটুয়াখালীর বাউফল সদর ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের সদস্য। সর্বশেষ গত ৭ ফেব্রুয়ারি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ফের তিনি সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
অপরদিকে, হারুন মল্লিক (৩৫) গত ৩১ জানুয়ারি বাউফল পৌরসভা নির্বাচনে ১নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।
হারুন মল্লিক ও শানু হাওলাদার এলাকায় পরোপকারী, জনদরদি, দানবীর ও সৎ জনপ্রতিনিধি হিসেবে পরিচিত। বাউফলে তারা জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধি হলেও সারা দেশে শানু হাওলাদার ও হারুন মল্লিকের রয়েছে গাড়ি চুরির ভয়ঙ্কর নেটওয়ার্ক।
দেশের বিভিন্ন থানায় তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক মামলা। পুলিশের তালিকায় পেশাদার গাড়ি চোর হিসেবে হারুন মল্লিক এবং শানু হাওলাদারের নাম রয়েছে।
সর্বশেষ ২০২১ সালের ২১ মে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপির) একটি টিমের হাতে গাড়ি চুরির মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন শানু হাওলাদার ওরফে শানু মেম্বার।
অপরদিকে, গত ১ এপ্রিল মাদারীপুরে সিএনজিচালিত গাড়ি ছিনতাইয়ের সময় গণধোলাইয়ের শিকার হন হারুন মল্লিক। পরে মাদারীপুর জেলার ডাসার থানা পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। বর্তমানে কারাবন্দি আছেন বাউফল পৌরসভার নবনির্বাচিত কাউন্সিলর হারুন মল্লিক।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাউফল সদর ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের আব্দুস সাত্তার হাওলাদারের ছেলে শানু হাওলাদার কিশোর বয়সেই ঢাকায় থেকে বিভিন্ন গাড়ির গ্যারেজের কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন। এক সময় গাড়ি ছিনতাইকারী চক্রে নাম লেখান তিনি। অভিনব কায়দায় গাড়ির যন্ত্রাংশ চুরি ও ছিনতাই কাজে দক্ষতার কারণে সারাদেশেই চোর সিন্ডিকেটের সঙ্গে তার নেটওয়ার্ক গড়ে উঠে।
প্রায় ১০ বছর আগে শানু হাওলাদারের সঙ্গে এ চুরি পেশায় যুক্ত হন বাউফল পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডের মৃত চান্দু মল্লিকের ছেলে ও বাউফল পৌরসভা নির্বাচনে ১নং ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর হারুন মল্লিক।
বর্তমানে ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, কুমিল্লা, বরিশাল ও মাদারীপুরসহ বিভিন্ন শহরে প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাসসহ বিভিন্ন গাড়ির যন্ত্রাংশ চুরি ও সিএনজিচালিত গাড়ি ছিনতাই চক্রের সিন্ডিকেট রয়েছে তাদের।
গাড়ি চোর হলেও শানু মেম্বার ও হারুন মল্লিক নিজ গ্রামে সামাজিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে হয়ে উঠেছেন দানশীল ব্যক্তি। এলাকায় নানা ইতিবাচক কর্মকাণ্ড করে একজন বাউফল সদর ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার এবং অন্যজন বাউফল পৌরসভার কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন।
শুধু তাই নয়, বাউফল উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক কমিটিতেও সদস্য হিসেবে নাম রয়েছে শানু হাওলাদারের। হারুন মল্লিকও একই দলের সমর্থক।
এ বিষয়ে জেলা বিএনপির নেতা আলী আজম ক্ষোভ প্রকাশ করে ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, এ ধরনের বিতর্কিত ব্যক্তিদের কারণে দলের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
একাধিক এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শানু মেম্বার ছিলেন দরিদ্র পরিবারের সন্তান। কিশোর বয়সে ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় তিনি ঢাকায় গিয়ে বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে কেয়ারটেকার ও গাড়ির গ্যারেজে কাজ শুরু করেন।
দীর্ঘ বছর পর হঠাৎ একদিন এলাকায় এসে শানু নিজেকে ঢাকায় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ও বড় ব্যবসায়ী হিসেবে দাবি করেন। এরপর হতদরিদ্রদের মধ্যে নগদ টাকা, চাল, ডাল ও কাপড় বিতরণ শুরু করেন।
নেছার উদ্দিন নামের এক ব্যক্তি ঢাকাপ্রকাশ-কে জানান, শানু মেম্বার এলাকার মানুষের কাছে একজন বটবৃক্ষ। তার কাছে কোনো অসহায় ব্যক্তি সাহায্যের জন্য গেলে তিনি সর্বোচ্চ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। দীর্ঘ বছর ধরে এলাকার দরিদ্রদের সাহায্য করার কারণে ‘দানবীর’ হিসেবে খ্যাতি ছড়িয়েছে তার।
মো. ফারুক হোসেন নামের অপর এক ব্যক্তি ঢাকাপ্রকাশ-কে জানান, শানু মেম্বার ঢাকায় কী করেন না করেন সে বিষয়ে আমরা কিছুই জানতাম না। তিনি (শানু) এলাকায় একজন সৎ ইউপি সদস্য হিসেবে পরিচিত। তার বিরুদ্ধে সরকারি কোনো বরাদ্দ চুরির অভিযোগ নেই। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে ঈদ উপহার হিসেবে জনপ্রতি সাড়ে ৪০০ টাকা বিতরণ করেন তিনি। নির্দিষ্ট তালিকায় থাকা সুবিধাভোগীদের বাইরেও পকেট থেকে অতিরিক্ত ব্যক্তিদের দান করেন তিনি।
এলাকার দরিদ্র নারী-পুরুষের কাছে প্রকৃত সমাজসেবক হিসেবে জনপ্রিয় শানু মেম্বার। তার হাত ধরে উঠে আসা হারুন মল্লিকও একইভাবে সাধারণ মানুষের আস্থাভাজন হয়ে উঠেছেন। বর্তমানে তারা এলাকায় শান্তিপ্রিয় সমাজসেবক ও জনপ্রতিনিধি হিসেবে পরিচিত।
এদিকে পুলিশের একটি সূত্র জানায়, দেশের বিভিন্ন থানায় শানু মেম্বার ও হারুন মল্লিকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। অধিকাংশই গাড়ি চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা। ঢাকায় তাদের রয়েছে একাধিক বাহিনী। এ বাহিনীর সদস্যরা সিএনজি, ট্যাক্সি ক্যাবসহ বিভিন্ন গাড়িতে যাত্রী বেশে উঠে চালককে অজ্ঞান করে গাড়ি ছিনতাই করে। এই চক্রের সঙ্গে ঢাকার অভিজাত এলাকার বিভিন্ন ফ্ল্যাট বাড়ির দারোয়ান ও কেয়ারটেকারের সখ্যতা রয়েছে। এই সখ্যতার সুবাদে তারা অপকর্ম করে বেড়ান।
তবে গাড়ি চুরির অভিযোগ অস্বীকার করে শানু হাওলাদার ওরফে শানু মেম্বার ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আমার বিরুদ্ধে কোথাও কোনো মামলা নেই। বিএনপি করি, তাই প্রতিপক্ষরা আমার বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। আমাকে এলাকা থেকে বিতাড়িত করার উদ্দেশ্যে একটি চক্র ষড়যন্ত্র করছে। আর হারুন মল্লিকের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।
এদিকে, হারুন মল্লিক কারাগারে থাকায় তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
মাদারীপুরের ডাসার থানার ওসি মো. হাসানুজ্জামান ঢাকাপ্রকাশ-কে জানান, রিমান্ডে হারুন মল্লিক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। বর্তমানে গাড়ি চোরের পুরো সিন্ডিকেট শনাক্ত করার কাজ চলছে।
বাউফল থানার ওসি আল মামুন ঢাকাপ্রকাশ-কে জানান, শানু মেম্বার ও হারুন মল্লিক পেশাদার চোর। বর্তমানে শানু মেম্বার জামিনে আছেন আর হারুন মল্লিক কারাগারে।
এমএসপি