‘হাওর ডুবায় আমরা নিঃস্ব অইগিলাম'
স্বপ্নটা খুবই ছোট। শুধুই খেয়ে-পরে বাঁচার। বোরো ফসল দিয়েই সারা বছরের স্বপ্ন বুনেন সুনামগঞ্জের হাওরের কৃষকেরা। কিন্তু পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে গেছে সেই স্বপ্ন। পরিণত হয়েছে সারা বছরের দুঃস্বপ্নে।
একের পর এক হাওর পানিতে ডুবে যাদের ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তাদের চিন্তা এ বছর তারা চলবেন কীভাবে। কেউ কেউ তলিয়ে যাওয়া ধান কাটছেন গরুর খাবারের জন্য। হাওরজুড়ে আর্তনাদ করছে কৃষকের দীর্ঘশ্বাস।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার কানলার হাওরপাড়ের কৃষক শফিকুল ইসলাম এবার বিরামপুর এলাকায় আট একর বোরো ফসল আবাদ করেছিলেন। সংসারের অভাব দূর হবে সে স্বপ্ন ছিল কৃষক শফিকুল ইসলামের। কিন্তু উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কেড়ে নিল শফিকুল ইসলামের মুখের হাসি। তলিয়ে গেল কানলার হাওরের পুরো বোরো ফসল। পানিতে তলিয়ে যাওয়া কাঁচা ধানই কেটে নিচ্ছেন তিনি। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতির শিকার হওয়া কৃষক শফিকুল ইসলামের চোখে-মুখে এখন হতাশার ছাপ।
তিনি ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘হাওর ডুবার আগে দিনের অবস্থা মোটামুটি ভালা আছিল, আগেই হুনছিলাম ইবার বন্যা টন্ন্যা অইব। খুব ভয়ের মাঝে আইলাম দিন নাই রাইত নাই হাওরটা পাহারা দিয়া রাখছিলাম কিন্তু কোনো লাভ হইল না। বান (বাঁধ) ভাঙিয়া (ভেঙে) আমার সব ধানসহ আমরার হাওর পানির তল (তলিয়ে) করিলাইছে। ‘হাওর ডুবায় আমরা নিঃস্ব অইগিলাম। কিন্তা হইল ইতা দুই নাম্বারি বান (বাঁধ) দিয়া। এখন গতবারের মতো গরু বেইচ্ছা (বিক্রি) খাইতে হইব।
২০১৭ সালে পাহাড়ি ঢলে হাওর ঢুবে ফসল নষ্ট হয়ে গেলেও সরকারি সহায়তা পাননি শফিকুল ইসলাম। সংসার চালিয়েছেন গরু বিক্রি করে ও জমি বন্ধক দিয়ে। একই অবস্থা ডুবে যাওয়া কানলার হাওরের অন্য কৃষকদের। শফিকুল ইসলামের মতো অনেক কৃষকই কাঁচা, আধাপাকা ধান কাটছেন।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুনামগঞ্জে প্রতি ৪-৫ বছর পর পর হাওরে চরম বিপর্যয় নেমে আসে। অকাল বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে হাওরের ফসলের ক্ষতি হয়। ২০১৭ সালে সুনামগঞ্জ জেলার হাওর বিপর্যয়ের পর শঙ্কামুক্ত ৪ বছর কাটানোর পর আবারও ধাক্কা খেলেন কৃষকেরা। গত ৩০ মার্চ মেঘালয় ও চেরাপুঞ্জি থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জ জেলার নদ-নদীর পানি অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পায়। এরফলে ঝুঁকিতে পড়ে হাওরের বোরো ফসল। এ অবস্থা অব্যাহত থাকার কারণে সর্ব প্রথম তাহিরপুরের নজরখালী বাঁধ ভেঙে টাঙ্গুয়ার হাওরের ফসল ডুবে যাওয়াসহ একের পর এক ছোট-বড় কয়েকটি হাওরের ফসলহানি ঘটেছে। তবে জেলার বড়বড় হাওরের ফসল ক্ষতি হয়নি।
চাপতির হাওরে দিরাই উপজেলার জগদল ইউনিয়নের কৃষক ইমান আলী জানান, এবার ১৪ কেদার জমিনে বোরো আবাদ করেছেন তিনি। গত কয়েকদিন ধরে হাওরের ফসল পানিতে তলিয়ে গেলেও কাটতে হিমশিম খাচ্ছেন। তার কারণ ধান কাটাতে শ্রমিকের টাকা দিতে পারবেন না, আবার ধান না কাটলেও গবাদিপশুকে না খেয়ে মরতে হবে। তাই তিনি একাই নিজের ১৩ বছর বয়সি ছেলেকে নিয়েই তলিয়ে যাওয়ায় কাঁচা কাটা ধান কাটছেন। তার সব ক্ষোভ বাঁধ নিয়ে।
কৃষক ইমান আলী ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, পাঁচ কেয়ার জমি করেছিলাম। সবগুলো জমির কাঁচা ধান পানির নিচে আছে। এখলা (একা) আমি না আমার লাখান (মতো) কয়েটা গ্রামের মানুষের বোরো ফসল ডুবেছে। কোনতা আর বাকি রইল না, সব পানির নিচে ডুইব্বা গেলে রে ভাই আর আমরার কিচ্ছু নাই। ধান নাই, খড়ও নাই। এখন গরুরে কিতা অই খাবাইমু?ইতার লাগি (এর জন্য) কাঁচা ধান কাইট্যা নিলাম বাড়িত। এ কাঁচা ধান মানুষে খাওয়ার মতো উপযুক্ত না।
এসময় তিনি আরও বলেন, বেড়ি বানের (বাঁধ) কাম ঠিক মতো হইছে না। আমি দোয়া করি আর কোনো বান (বাঁধ) যেনো না ভাঙে। আমার মতো ফসল হারা যেনো আর কেউ না হয়।
কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সুনামগঞ্জের ছোট-বড় ১৫৪টি হাওরে এবার ২ লাখ ২২ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, ৩ হাজার ২২০ কোটি টাকার বোরো ধান। চলতি মৌসুমে জেলার ১২টি উপজেলার বিভিন্ন হাওরে বোরো ফসলের সুরক্ষার জন্য ৭২৪টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) মাধ্যমে ১৩০টি ঝুঁকিপূর্ণ ক্লোজারসহ ৫৩২ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। এ জন্য সরকার ১১৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, আমরা দিনরাত কাজ করছি। জেলার বিভিন্ন হাওরে ধান কাটা শুরু হয়েছে। শ্রমিকদের সঙ্গে মাঠে ধান কাটার মেশিনও আছে। মাঝখানে পানি কিছুটা কমেছিল। কিন্তু এখন আবার বাড়ছে, তাতে আমরা আতঙ্কিত। আর যদি কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না আসে তাহলে কৃষকেরা তাদের ফসল গোলায় তুলতে পারবেন।
হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ও ফসলহানির ঘটনায় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়। সেই তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সৈয়দা সালমা জাফরিন মঙ্গলবার (১২ এপ্রিল) সকাল থেকে জেলার ধর্শাপাশা উপজেলার চন্দ্রসোনার থাল হাওরসহ তাহিরপুরের টাঙ্গয়ার হাওরের নজরখালী এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ ও ফসল পরিদর্শন করেন এবং স্থানীয় কৃষক ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেন।
ধর্মাপাশা উপজেলার চন্দ্র সোনার থাল হাওর পরিদর্শন শেষে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সৈয়দা সালমা জাফরীন বলেন, হাওরের বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত যারা, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, হাওরে ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন বাঁধ আমরা পরিদর্শন করছি। এরই মধ্যে ধর্মপাশা উপজেলার চন্দ্র সোনার থাল হাওর পরিদর্শন করেছি। আমরা যত দ্রুত সম্ভব তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দেব।
এসএন