লবণাক্ততায় মাতৃত্ব হারাচ্ছেন উপকূলের নারীরা
জীবন ও জীবিকা- যেমন একটি আরেকটির অবিচ্ছেদ্য অংশ, ঠিক তেমনই নারী ও মাতৃত্ব- একটি আরেকটির সঙ্গে ভীষণভাবে সম্পর্কিত। তবে কখনো কখনো মাতৃত্বের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়ায় জীবিকা। বিষয়টি খানিকটা অমীমাংসিত হয়ে দাঁড়িয়েছে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার নারীদের কাছে। খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতেই মাতৃত্বের ঝুঁকি নিয়েও কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে তারা।
জীবিকার জন্যই প্রতিদিন লবণাক্ত পানিতে কোমর পর্যন্ত ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয় এখানকার নারীদের। ফলে জরায়ুতে ইনফেকশন, টিউমার, ক্যান্সার, জরায়ু নেমে যাওয়ার মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। এতে করে মাতৃত্ব হারানোর মতো সংকটে পড়ছেন অনেক নারীই।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ততা বেড়ে গেছে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার উপকূলীয় অঞ্চলের পানিতে। দৈনন্দিন সব কাজে লবণাক্ত পানি ব্যবহার করতে হয় এ অঞ্চলের নারীদের। এ ছাড়া জীবিকার তাগিদে দীর্ঘক্ষণ চিংড়ির ঘেরে কোমর পানিতে ডুবে থেকে কাজ করেন অনেকেই৷ ফলে জরায়ুর নানা আক্রান্ত হচ্ছেন নারীরা। অল্প বয়সেই জরায়ু কেটে ফেলতে হয়েছে গ্রামের অনেক নারীর। আর এ কারণে তালাকের শিকার হতে হয়েছে কাউকে কাউকে।
খোজঁ নিয়ে জানা যায়, গাবুরার মতো একই চিত্র সাতক্ষীরার উপকূলীয় উপজেলাগুলোতে। ২০০৯ সালে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আইলার পর থেকে উপকূলীয় অঞ্চলগুলো লোনাপানির কবলে পড়ে। তারপর থেকে প্রায় প্রতি বছরই প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যা-জলোচ্ছ্বাস লেগেই আছে। বর্ষা মৌসুমে সামান্য সময়ের জন্য একটু বৃষ্টির পানির দেখা মিললেও বাকি সময়টা কাটাতে হয় লোনাপানিতে। ফলে, দেশের অন্যান্য স্থানের তুলনায় জন্মহার কমে যাচ্ছে এসমস্ত অঞ্চলে। মাতৃত্ব ঝুঁকিতে রয়েছেন এ অঞ্চলের নারীরা। অপুষ্টি ও জরায়ুজনিত স্বাস্থ্য সমস্যায় নারীদের কমে যাচ্ছে সন্তান ধারণের ক্ষমতা।
শ্যামনগর উপজেলার হরিশখালী গ্রামের তাহমিনা ঢাকাপ্রকাশকে জানান, তার জরায়ুতে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে বছর কয়েক আগে। বর্তমানে তার পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন চর্মরোগে আক্রান্ত রয়েছেন।
পাশ্বেমারী গ্রামের মর্জিনা খাতুন ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, 'স্বামীর আয়ে সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে আমি নদীতে জাল টেনে মাছ ও কাঁকড়া ধরে বিক্রি করি। আমার মতো এ অঞ্চলের অনেক নারী নদীতে জাল টেনে জীবিকা নির্বাহ করেন। প্রতিদিন লোনা পানিতে দীর্ঘ সময় থাকার কারণে আমাদের শরীরে বিভিন্ন ধরনের রোগ হয়েছে। একই সঙ্গে আমরা জরায়ু সংক্রান্ত নানা জটিলতায় ভুগছি।'
একই ইউনিয়নের পারভীন আক্তার বলেন, 'আমাদের অনেক সমস্যা মোকাবেলা করে জীবনযাপন করতে হয়। বিশেষ করে সুপেয় খাবার পানির কষ্ট, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থাকলেও কাঙ্ক্ষিত সেবা পাওয়া যায় না। এ ছাড়া লবণাক্ততার কারণে অপুষ্টি ও জরায়ুজনিত স্বাস্থ্য সমস্যার শিকার হচ্ছি। গর্ভধারণের ক্ষেত্রে জটিলতার শিকার হচ্ছি।’
শ্যামনগর উপজেলার মৌ-খালি গ্রামের শাহানারা খাতুন, শাহিদা আক্তার, ফিরোজা খাতুন, ফাতেমা খাতুন, মোমেনা খাতুনসহ একাধিক নারীর জরায়ু কেটে ফেলা হয়েছে।
মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের উত্তর কদমতলা (ফুলতলা) গ্রামের পঞ্চানন মণ্ডলের স্ত্রী কল্পনা রানী মণ্ডল বলেন, 'জরায়ু, অ্যাপেন্ডিসাইটিস ও টিউমার তিনটি অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে তার। জরায়ু কেটে বাদ দিতে হয়েছে তার। আমাদের এদিকের পানি লবণাক্ত। সেজন্য নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছি আমরা। আমি খুলনায় অপারেশন করেছি। আমাদের পাড়ার মধ্যেই এমন ১০-১৫ জন রয়েছে। তাদের অধিকাংশই জরায়ু সমস্যায় ভুগছেন।'
একই উপজেলার সোরা গ্রামের আসমা বেগম বলেন, সাত বছর আগে মাত্র ২৩ বছর বয়সে অপারেশনের মাধ্যমে জরায়ু কেটে ফেলেন তিনি। এদিকে জরায়ু কেটে ফেলায় স্বামী বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। সেই থেকে পিতার সংসারে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি।'
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক নারী ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, জরায়ু কেটে ফেলার কারণে স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে গেছে তাদের। অপারেশনের বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর তাদের আবার বিয়ে করার বিষয়েও সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন তারা। আবার বাবার বাড়িতেও থাকতে নানা গঞ্জনার মধ্যে দিয়ে।
স্থানীয় একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কর্মী আরিফা খাতুন ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, 'গাবুরা ও পদ্মপুকুর ইউনিয়নে দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে আমাদের। লবণাক্ততা ও জলাবদ্ধতার প্রধান শিকার এখানকার নারীরা। পানিবাহিত রোগের কারণে নারীদের জরায়ু টিউমার, জরায়ু ক্যানসারসহ বিভিন্ন জটিল রোগে ভুগতে হয়। অল্প বয়সে অনেকে জরায়ু অপসারণ করতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে করে এখানকার নারীদের সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা কমে যাচ্ছে।'
মানবাধিকার কর্মী মাধব চন্দ দত্ত ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, 'উপকূলীয় অঞ্চলের নারীদের সার্ভাইকাল ক্যান্সার হচ্ছে। জরায়ুর বিভিন্ন সমস্যা হচ্ছে। এখানে পর্যাপ্ত সুপেয় নিরাপদ পানির অভাব রয়েছে। এ ছাড়া কর্মসংস্থানের অভাবে এ অঞ্চলের মানুষ অভিবাসী হয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে।'
এ ব্যাপারে শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) অজয় কুমার সাহা ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘প্রায় প্রতিদিনই নারীরা তাদের নানা ধরনের চর্মরোগ নিয়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসেন। অনেকের অপারেশন করে জরায়ু কেটে ফেলতে হচ্ছে। লবণাক্ত পানি ব্যবহারের কারণে এ ধরনের সমস্যা তৈরি হয়েছে।
এসএন