সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হিজাব বিতর্কের ঘটনা সত্য নয়
নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার দাউল বারবাকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের হিজাব পরে স্কুলে যাওয়ায় ছাত্রীকে পেটানোর ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়নি। ঘটনার সময় উপস্থিত শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, স্কুল ড্রেস না পরার কারণে ছাত্রছাত্রীদের শাসন করা হয়েছে। এর সঙ্গে হিজাবের কোনো সম্পর্ক ছিল না।
মারধরের শিকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে সনাতন ধর্মের ছাত্রী ও ছাত্ররাও ছিল বলে নিশ্চিত করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিজানুর রহমান।
গত ৬ এপ্রিল ওই স্কুলের শিক্ষার্থীদের পেটানোর এ ঘটনা ঘটলেও এটি প্রকাশ্যে এসেছে গত (৭ এপ্রিল)। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে অভিযোগ করা হয়, শিক্ষার্থীরা হিজাব পরার কারণে ওই স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক আমোদিনী পাল ছাত্রীদের মারধর করেন।
কয়েকজন শিক্ষার্থী এদিনের ঘটনা সম্পর্কে জানায়, হিজাবের কারণে সেদিন কাউকে মারধর করা হয়নি। মারধর করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সনাতন ধর্মের মেয়ে ও ছেলেরাও ছিল। স্কুলড্রেস পরে না আসার কারণে মেয়েদের মারধর করেন শিক্ষক আমোদিনী পাল। আর ছেলেদের মারধর করেন বদিউজ্জামান নামে আরেক শিক্ষক। এরপর বাড়ি চলে যায় অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির প্রায় ২০ জন শিক্ষার্থী। ঘটনার পরদিন এ নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
দশম শ্রেণির দুই শিক্ষার্থী দীপা ও কাকলী রানী জানায়, ওই দিন ইউনিফর্ম ঠিকমতো পরে না আসায় আমোদিনী পাল ও বদিউল আলম তাদের অনেককে শাসন করেন। কিছু মারধরও করেন। তবে হিজাব নিয়ে টানাহেঁচড়ার মতো ঘটনা ঘটেনি।
আল মোক্তাদির নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমি শুরু থেকে ছিলাম, জাতীয় সংগীতের সময় স্কুলের ড্রেস না পরা কিছু ছেলেমেয়ে ছিল, তাদের মারছিলেন। বদিউল স্যার আগে ছেলেদের মারেন। এক সপ্তাহ আগে বদিউল স্যার স্কুলড্রেস পরে আসতে হবে বলেছিলেন। মেয়েদেরও তা বলা হয়েছিল। হিজাবের জন্য কাউকে মারা হয়নি।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত শিক্ষক আমোদিনী পাল বলেন, ‘স্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষক ধরণী কান্ত বর্মণ ও কমিটির একটি পক্ষ এ গুজব ছড়িয়েছে। আমার সম্মান ক্ষুণ্ণ হয়েছে। আমি সুষ্ঠু বিচার চাই।’
আমোদিনী পাল আরও বলেন, ‘কোনো ধর্মীয় ইস্যুতে নয়। স্কুলড্রেস পরে না আসাতেই সেদিন শিক্ষার্থীদের কিছুটা শাসন করেছিলাম। এখন সেই ঘটনায় ধর্মীয় রং লাগানো হচ্ছে। কিছু লোক এ কাজ করছে।’
এদিকে আমোদিনী পালের তোলা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন প্রধান শিক্ষক ধরণী কান্ত বর্মণ। তিনি বলেন, 'ওনার (আমোদিনী পাল) সঙ্গে তো আমার বিরোধ নেই, কারণ তিনি সহকারী প্রধান শিক্ষক, আমার পর তো উনিই প্রধান শিক্ষক হবেন। এটা তো আইন হিসেবেই পাবেন। এটা নিয়ে তো আমার কিছু নেই।’
তিনি আরও বলেন, 'বুধবার বিদ্যালয়ে ছিলাম না। আমি ওই দিন রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে ছিলাম। পরদিন আমি স্কুলে গিয়ে ঘটনাটা জানতে পারি। হিজাবের বিষয়টা আমি নিশ্চিত নয়, কারণ আমি ছিলাম না।'
এ বিষয়ে বিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক বদিউল আলম বলেন, ‘প্রতিদিন বলা হয় ইউনিফর্মের কথা। ম্যাডাম দুয়েকজনকে একটু মেরেছেন। ম্যাডাম কিন্তু এমনিতে কখনো মারেন না। ছাত্রদেরও কেউ কেউ অন্য ড্রেস, গেঞ্জি এসব পরে আসছে। আমরা তো সব সময় বলি স্কুলড্রেস পরে আসতে।’
তিনি আরও বলেন, ‘হঠাৎ বৃহস্পতিবার এসব ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া সরগরম হয়েছে। আসলে এ রকম কিছু তো না। হিজাব নিয়ে কিছু হয়েছে বলে তো শুনিনি। ভুল বোঝাবুঝি কিছু হয়েছে হয়তো।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিজানুর রহমান জানান, উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশের একজন এএসপির সমন্বয়ে একটি দল অভিযুক্ত সহকারী প্রধান শিক্ষক আমোদিনী পাল, মারধরের শিকার শিক্ষার্থী ও বিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেন। সব পক্ষের বক্তব্যে মনে হয়েছে, ওই শিক্ষক স্কুলড্রেস না পরে আসায় শাসন করেছেন। মারধরের শিকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে একজন সনাতন ধর্মেরও ছিল। শুধু তাই নয়, ঘটনার দিন ৬ এপ্রিল স্কুলড্রেস পরে না আসার কারণে কয়েকজন ছেলে শিক্ষার্থীকেও শাসন করা হয়। ঘটনাটি পরে হিজাব বিতর্কের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে মনে হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আব্দুল মালেককে প্রধান করে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।’
এ ব্যাপারে নওগাঁর পুলিশ সুপার আব্দুল মান্নান মিয়া জানান, এ ঘটনার পর অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে দাউল বারবাকপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও এর আশপাশের এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক খালিদ মেহেদী হাসান বলেন, ‘ওই স্কুলের শিক্ষার্থীদের বেত দিয়ে মারা হয়েছে, এটা সত্য। তবে সেটা হিজাবের কারণে নয়, স্কুলড্রেস না পরে আসার কারণে মারা হয়েছে। স্কুলে মুসলিম ছাত্র ও সনাতন ধর্মের ছাত্রীদেরও শাসন করা হয়েছে। ওই ঘটনার সময় বদিউল আলম নামে একজন মুসলমান শিক্ষকও ছিলেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে একজন হিন্দু শিক্ষকের পক্ষে এমন সাহস কতটুকু হবে একটু ভাবা দরকার। ঘটনাটি আমরা তদন্ত করছি। গুজব সম্পর্কে সবাইকে সচেতন থাকার আহ্বান জানান তিনি।’
এসএন