খুলনায় দখলমুক্ত হয়নি খাল, বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পানি নিষ্কাশন
সরকারি হিসাবে খুলনা জেলায় ২ হাজার ২০০ কিলোমিটার খাল রয়েছে। সরকারি এসব খালের মধ্যে ৫৬০ কিলোমিটার বা প্রায় ২৫ শতাংশ বেদখল হয়ে গেছে। নির্মাণ করা হয়েছে নানা স্থাপনা।
গ্রামপর্যায়ে এসব সরকারি খাল দখল অথবা ইজারা নিয়ে খণ্ড খণ্ড করে মাছ চাষ করছেন প্রভাবশালীরা। শহর ও শহরতলীর সরকারি খাল দখলে নিয়ে গড়ে তোলা হচ্ছে আবাসন প্রকল্প। বাকি খালগুলো ময়লা-আবর্জনা ও দূষণে ধুঁকছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, খুলনা নগরের বুকচিরে বয়ে যাওয়া ‘ময়ূরনদ’ এখন দেখতে অনেকটা বড় খালের মতোই। গত তিন বছরে এ নদ দখল করে নতুন কোনো স্থাপনা গড়ে না তোলা হলেও নদ ভরাট করে যে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছিল, সেগুলো খনন হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বছরখানেক আগে থেকেই এ নদে জলজপ্রাণী বেঁচে থাকার মতো দ্রবীভূত অক্সিজেন নেই। ফলে নদ দখলমুক্ত করার সঙ্গে প্রাণ ফিরিয়ে আনার যে দাবি উঠেছিল, তা বাস্তবায়িত হয়নি। যুগের পর যুগ এভাবে অস্তিত্ব হারাচ্ছে অনেক নদী-খাল। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে সুষ্ঠু পানি নিষ্কাশনের পথ। নষ্ট হচ্ছে পানির আধার। যা প্রকৃতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আর ভবিষ্যতের প্রকৃতিতে ডেকে আনছে চরম বিপর্যয়।
সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, বেশিরভাগ জলাশয় অথবা খাল ময়লা-আবর্জনা, দূষণে ছোট ও সরু হয়ে গেছে। শহর ও এর আশপাশ এলাকার খালগুলো টার্গেট করে ভূমি অফিসের একশ্রেণির কর্মকর্তার সহযোগিতায় ভূমিহীন সেজে অনেকেই বরাদ্দ নিয়ে বেআইনিভাবে তা বিক্রি করছেন আবাসন ব্যবসায়ীদের কাছে। খুলনা নগর ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকার এরকম ৫০টি খালের মধ্যে তিনটির অস্তিত্বই নেই। আর যা আছে তার ৮০-৯০ শতাংশ অবৈধ দখলে গেছে।
জেলার সবচেয়ে বেশি সরকারি খাল-জলাশয় ভরাটের ঘটনা ঘটছে শহরসংলগ্ন ডুমুরিয়া উপজেলায়। শহরের পার্শ্ববর্তী হওয়ায় এ উপজেলার খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়ের জিরো পয়েন্ট থেকে চুকনগর পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশের সরকারি-বেসরকারি জায়গা আবাসন ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে দখল করে বালু ভরাট করছেন। এতে নষ্ট হচ্ছে আবাদি জমি।
ডুমুরিয়ার গুটুদিয়ার বাসিন্দা রেজাউল করিম জানান, ব্রিটিশ শাসনামলে পরিচালিত সরকারি জরিপের (সিএস) ম্যাপে ডুমুরিয়া উপজেলার গুটুদিয়া মৌজায় লেবুনার খাল ছিল। কৈয়া বাজারের সন্নিকটে খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের কালভার্ট এখনও তার সাক্ষ্য বহন করে। অথচ দেশের সর্বশেষ জরিপের (বিএস) ম্যাপে সেইখাল ব্যক্তিমালিকানায় চলে গেছে। ফলে বর্ষা মৌসুমে পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে।
রাজবাঁধ এলাকার বাসিন্দা আব্দুস সালাম ও মোস্তফা মোড় এলাকার বাসিন্দা কারিমুল হোসেন জানান, মোস্তফার মোড়-কৈয়া বাজার সড়কের রাজবাঁধে খালের মুখ বন্ধ করে আবাসন ব্যবসা গড়ে তুলেছে বিশ্বাস প্রোপার্টিজ। নতুন রেললাইনের পাশ দিয়ে বহমান খালটি রওশন প্রোপার্টিজ দখল করে সরু করে ফেলেছে। তানিশা আবাসন প্রকল্পের সামনের খালও অনুরূপ ছোট হয়ে গেছে। এতে বর্ষা মৌসুমে পানি নিষ্কাশন পথ সংকুচিত ও বন্ধ হয়ে গেছে।
ডুমুরিয়া উপজেলার বাসিন্দা মোহাম্মদ হোসেন জানান, বামুন্দিয়া বিলের বাওড়ের খাল প্রভাবশালীরা ইজারা নিয়ে ঘের ব্যবসা পরিচালনা করছেন। তারা ইজারার চুক্তিপত্র ভেঙে খালে বেড়িবাঁধ, পাটা ও নেট দিয়ে পানির স্রোত বন্ধ করছে। সাব-লিজও দিচ্ছেন তারা। ফলে বর্ষা মৌসুমে পানি নিষ্কাশনের পথ বাধাগ্রস্ত হয়ে আশপাশের বাসিন্দারা পানিবন্দি হয়ে পড়েন। ক্ষতির মুখে পড়ছে ফসলিজমি ও ছোট ছোট মৎস্যঘের।
বেলার খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমান মুকুল বলেন, কোনোভাবেই খালের শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। কারণ খাল না থাকলে পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে জলবদ্ধতা তৈরি হবে, মশা জন্ম নেবে এবং কার্বন নিঃসরণ বন্ধ হয়ে তাপমাত্রা বাড়বে। কৃষক ফসল ফলাতে পানি পাবে না। যারা মাছ শিকার করে জীবিকানির্বাহ করেন তারা বেকার হয়ে পড়বেন।
ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, ডুমুরিয়া উপজেলায় ১২৫টি ছোট-বড় সরকারি খাল রয়েছে। এরমধ্যে ৫০০ কিলোমিটার ভরাট হয়ে বেদখল হয়ে গেছে। এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
খুলনা রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট নয়ন কুমার রাজবংশী বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড খাল দেখাশোনা করে। কোনো খাল খনন বা ব্যবহারে তারা জেলা প্রশাসন থেকে অনাপত্তিপত্র গ্রহণ করে। এ ছাড়া ২০ একরের নিচে জলমহল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ২০ একরের নিচে জলমহল তার দপ্তর ইজারা দেয়।
খুলনা কৃষি সম্প্রারণ অধিদপ্তর উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. হাফিজুর রহমান বলেন, খুলনা জেলায় ২২০০ কিলোমিটারের মতো সরকারি খাল রয়েছে। এরমধ্যে ৫৬০ কিলোমিটার খাল ভরাট হয়ে বেদখল হয়েছে। এসব খাল উদ্ধার করে খনন করে জলাধার সৃষ্টি করলে কৃষিপণ্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখবে।
খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব পাল বলেন, মাছচাষে আগ্রহী ও চাষের উপযোগী রাখতে প্রকল্পের আওতায় মৎস্য বিভাগ প্রতি বছর কিছু খাল খনন করে।
তবে কী পরিমাণ খাল অস্তিত্ব হারিয়েছে বা বেদখল আছে তার কোনো পরিসংখ্যান তার দপ্তরে নেই। খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম বলেন, খুলনার ৯ উপজেলা মোট ৩৮৯টি সরকারি খাল রয়েছে। এরমধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর আওতায় রয়েছে ২৬২টি খাল এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর আওতায় রয়েছে ১২৭টি। পানি নিষ্কাশনের পথ সচল ও ফসলিজমিতে পানির উৎস হিসেবে ব্লু গোল্ডের আওতায় ১৫৪টি খাল খনন করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও ৭৪টি খাল খননের প্রস্তাব করা হয়েছে।
খুলনা জেলা প্রশাসক মো. মনিরুজ্জামান তালুকদার বলেন, সরকারি খাল ও জলাশয় ভরাট করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। এ কাজের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে।
এসএন