সোনাগাজীতে পতিত জমিতে তরমুজের চাষাবাদ লক্ষ্যমাত্রার দ্বিগুণ
যেদিকে চোখ যায় তরমুজের সবুজ ক্ষেত। সুবিশাল এ সবুজের মধ্যে শোভা পাচ্ছে রসালো তরমুজ। কেউ গাছ থেকে ফলন ছিঁড়ছেন, কেউ তরমুজের যত্ন নিচ্ছেন। সোনাগাজী উপজেলার পূর্ব, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পতিত জমি ও বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল নদীর তীরে আগে কখনো ফসল ফলেনি। পতিত জমি হিসেবে পড়ে থাকত। সামান্য কিছু জমিতে ধান আর ঢেঁড়স চাষ হতো। উপজেলার আদর্শগ্রাম, চর কৃষ্ণজয়, ফতেহপুর, মোবারকঘোণা, রঘুনাথপুর, দক্ষিণ পশ্চিম চর দরবেশ, পূর্ব বড়ধলী, দক্ষিণ চর চান্দিয়া, ও মুহুরী প্রকল্প এলাকায় শতশত কৃষক পরিবারের চেষ্টায় সে পতিত চরে ও ঢেঁড়সের জমিতে এখন সবুজের সমারোহ। তরমুজে ভরে উঠেছে সেই নিষ্ফলা জমি। ফলন আর দাম হাসি ফুটিয়েছে শতাধিক কৃষক পরিবারের সদস্যদের মুখে।
সোনাগাজীতে উপজেলার চর দরবেশ ইউনিয়নের পশ্চিম চর দরবেশ গ্রামের কৃষক বেলায়েত হোসেন স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে আগে গরু-মহিষ পালনসহ বিভিন্ন লোকজনের কাছ থেকে জমি বর্গা নিয়ে ধান ও ঢেঁড়সের চাষ করতেন। গত দুই বছর উপজেলা কৃষি বিভাগের সহযোগিতায় বেলায়েত দুই ছেলে ও ছোট ভাই ফারুক হোসেনকে নিয়ে এখন পতিত ও ঢেঁড়সের জমিতে তরমুজের চাষ করছেন। নোয়াখালীর সুবর্ণচরের কয়েকজন কৃষক তার পাশের কিছু জমিতে হঠাৎ করে ২০২০ সালে তরমুজের চাষ করে। ফলনও বেশ ভালো হয়েছে। তাদের দেখে উৎসাহিত হয়ে তিনি নিজেও তরমুজ চাষে উদ্বুদ্ধ হয়ে চাষাবাদ শুরু করেন।
বেলায়েত হোসেন বলেন, এনজিও ও স্থানীয়দের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা দিয়ে ৫ হেক্টর জমিতে আগাম তরমুজের আবাদ শুরু করেন তিনি। ক্ষেতেই ছাপড়া ঘর তৈরি করে তিনিসহ ছয়জন শ্রমিক দিনরাত পরিচর্যা করেছেন। জমির পাশে একটি বড় দিঘি রয়েছে। সেখান থেকে মিষ্টি পানির সেচ দিয়েছেন তরমুজ ক্ষেতে।
তিনি আরও বলেন, ৫ হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ করতে খরচ হয়েছে ১০ লাখ টাকা। আগাম আবাদ করায় ক্ষেতেও আগাম তরমুজ উঠেছে। এরই মধ্যে ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি হয়েছে। বেলায়েত হোসেনের মতো দক্ষিণ ও পাশ্চিম চর দরবেশ ও ছোট ফেনী নদীর তীরে এ বছর ৫০ জন কৃষক ১০০ হেক্টর জমিতে আগাম তরমুজের চাষ করেছেন বলে জানিয়েছে উপজেলা কৃষি বিভাগ।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, উপজেলার বেশ কিছু এলাকায় কৃষি অনেকটাই আমন চাষ নির্ভর। সাধারণত এলাকার কৃষক ডিসেম্বর মাসে আমন ফসল তোলার পর জানুয়ারি মাস থেকে তরমুজের আবাদ শুরু করেন। মার্চ মাসে ক্ষেত থেকে তরমুজ তুলে বাজারে বিক্রি শুরু হয়। উপজেলায় এবার তরমুজ চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৩১৭ হেক্টর। কিন্তু চাষাবাদ লক্ষ্যমাত্রার দ্বিগুণ প্রায় সাড়ে ৫০০ হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ ছাড়িয়ে গেছে।
গত সোমবার সরেজমিনে আদর্শগ্রাম ও দক্ষিণ-পশ্চিম চর দরবেশ ও মুহুরী প্রকল্প এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ক্ষেত থেকে তরমুজ তুলে জড়ো করছেন কৃষকেরা। স্তূপ করে রাখছেন বিক্রির জন্য। ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও ফেনী থেকে এসে কয়েকজন ব্যবসায়ী তরমুজ কিনে গাড়িতে বোঝাই করছেন। এক ক্ষেতে সেচ দিতে দেখা গেল ফিরোজ আলম ও সামছুল আলম নামের দুই শ্রমিককে।
তারা জানান, দুজনের বাড়ির নোয়াখালীর সুবর্ণচর এলাকায় থাকা খাওয়া বাদে মাসিক ১৭ হাজার টাকা বেতনে বেলায়েত হোসেন নামে এক তরমুজ চাষীর জমিতে কাজ করছেন। এ বছর তাদের মালিক ৫ হেক্টর জামিতে তরমুজের আবাদ করেছেন। এতে তার ১০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। গত দেড়মাসে তরমুজ বিক্রি করে মোটামুটি পুঁজি উঠে গেছে।
আদর্শগ্রাম এলাকার তরমুজ চাষী মোজ্জামেল হক বলেন, তিনি ৪০ লাখ টাকা খরচ করে ৩৭ একর জমিতে তরমুজ চাষ করেছেন। ফলনও বেশ ভালো হয়েছে। ইতিমধ্যে ৩০ লাখ টাকার ফলন উত্তোলন করে বিক্রি করেছেন।
মো. ওলি উদ্দিন নামে এক তরমুজ চাষি বলেন, ৮০ একর জমিতে তারা ১০ জন কৃষক মিলে ৩৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে তরমুজের চাষাবাদ করেছিলেন। ইতিমধ্যেই ৪০ লাখ টাকার তরমুজ তারা বিক্রি করেছেন। আরও আনুমানিক ৩০ লাখ টাকার তরমুজ মাঠে আছে।
সুবর্ণচর থেকে আসা তরমুজের ব্যাপারী জসিম উদ্দিন বলেন, সোনাগাজীর চরাঞ্চলের তরমুজ অন্য এলাকার তরমুজের চাইতে গুণেমানে ভালো। তিনি এখানকার ২০ একর জমির তরমুজ কিনেছেন ২৮ লাখ টাকায়। পরিবহনসহ সব খরচ মিলিয়ে এ তরমুজ তিনি ৪০ লাখ টাকায় বিক্রি করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
চট্টগ্রাম থেকে আসা আমির হোসেন নামের আরেক ব্যাপারী জানান, তিনি ২০ একর জমির তরমুজ কিনেছেন ২৫ লাখ ৭০ হাজার টাকায়। এ তরমুজগুলো তিনি চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গিবাজার, সাতকানিয়া, লোহাগাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে যাবেন।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা কাজী শফিউল ইসলাম বলেন, এবার উপজেলায় ঢেঁড়সের জমিতে বেশি তরমুজ চাষ হয়েছে। অনেক চাষী ঢেঁড়স চাষে ব্যায়বহুল হওয়ায় কম খরচে তরমুজের চাষ করেছেন। কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারাও মাঠে থেকে তাদের পরামর্শ দিয়ে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন। যার ফলে লক্ষ্যমাত্রার দ্বিগুণ তরমুজের চাষ হয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেন মজুমদার বলেন, উর্বর দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটি তরমুজ চাষের জন্য সবচেয়ে উত্তম। এই এলাকার মাটি তরমুজ চাষের উপযোগী। সে জন্যই ভালো ফলন হয়েছে।
তিনি বলেন, ২০১৮ সালে উপজেলায় মাত্র ৫০ হেক্টর জমিতে তরমুজের চাষ হয়। ফলন ভালো হওয়ায় কৃষকরা ব্যয়বহুল চাষাবাদ বাদ দিয়ে তরমুজ চাষে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। এরপর ২০১১ সালে ১২৫ হেক্টর, ২০২০ সালে আড়াইশ হেক্টর, গত বছর উপজেলায় ৩১৭ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ হলেও এবার লক্ষ্যমাত্রার দ্বিগুণ সাড়ে ৫০০ হেক্টর ছাড়িয়ে গেছেন। গত বছর উপজেলায় প্রায় ২৬ কোটি টাকার তরমুজ বিক্রি হয়েছে। এবার তার তিনগুণ হবে। আশা করি আগামী মৌসুমে তরমুজের চাষ আরও অনেক বাড়বে।
টিটি/