জীবনের অর্থ, অর্থের জীবন
আমরা কেন এসেছি এই পৃথিবীতে? আমাদের জন্ম নেওয়ার উদ্দেশ্য কি? –এরকম নানা প্রশ্ন অনাদিকাল থেকে মানুষের মনে জেগেছে। বিভিন্ন ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞানসহ নানা পর্যায়ে এর ব্যাখ্যা আছে, বিতর্ক আছে। তবে আমরা যারা সাধারণ মানুষ, আমাদের মনে প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা যখন এসেই পড়েছি এই ধরাধামে, তখন আমাদের দায়-দায়িত্ব কার? আমাদের দেশের প্রায় শতভাগ লোক ধর্মে বিশ্বাসী। তাই কেউ কেউ হয়ত বলবেন, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে, আল্লাহ বা ইশ্বর আমাদের সব কিছুর মালিক। আমাদের জন্ম মৃত্যু উনার ইচ্ছায়। এতে মানুষের অবহেলায়, জিগাংসায় যে মৃত্যু, তাকে কি আমরা সহজে আল্লাহ বা ইশ্বরের উপর দায় চাপিয়ে দিতে পারি? এর ব্যাখ্যা দেবেন ধর্মীয় বিশেষজ্ঞরা।
তবে আম জনতা হিসেবে প্রশ্ন, স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মৃত্যুকে আল্লাহ বা ইশ্বরের উপর চাপাতে পারলেও অন্যসব মৃত্যুর দায় কার? এ পর্যায়ে আসে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র বা তদারকি প্রতিষ্ঠানের উপর! খোলা চোখে দেখলে ঘটনা, দুর্ঘটনা, অবহেলা, গাফেলিতেতে মৃত্যুর দায় তারা এড়াতে পারে না। এ কারণে ২০০১ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, সন্ত্রাসীদের গুলিতে বাবার কোলে এক শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় ‘আল্লাহ’র মাল আল্লাহ নিয়ে গেছেন’ বলে যথেষ্ট বির্তকের মুখে পড়েছিলেন।
সীতাকুণ্ডে, নীমতলীতে, তাজরিন গার্মেন্টেসে, রানা প্লাজায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড/ধসের ঘটনার যারা অকালে চলে গেছেন, তারা তো আর ফিরে আসবেন না। যাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন ছিলেন তারা, সেই স্বজনদের কি অবস্থা? একটি জীবনের অকাল মৃত্যু অনেক জীবনকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। কিছু দান খয়রাততো আর জীবনের মূল্য হতে পারে না। কিন্তু তারপরও কি আমাদের বোধোদয় হয়েছে? পুরান ঢাকার নীমতলীর অগ্নিকাণ্ডে ১১৭ জনের মৃত্যুর এক যুগ পেরোলেও কেমিক্যাল কারাখানা, দোকান বা গুদাম এখনো সেখানেই আছে। জনবহুল এলাকা থেকে এসব সরিয়ে নেওয়ার জন্য কত ট্রাস্কফোর্স, তদন্ত কমিটি, পরিকল্পনা হলো। কাজের কাজ কি কিছু হয়েছে? তাই হয়ত সেখানে আরও কোনো বড় ট্রাজেডি অবশ্যম্ভাবী হয়ে আছে!
আর যাদের উপর দেখভালের দায়িত্ব, রাষ্ট্র বা তার সংশ্লিষ্ট তদারকি প্রতিষ্ঠান কি করছে? সীতাকুণ্ডে এত বড় বেসরকারি বিএম কনটেইনার টার্মিনাল, যেখানে প্রতিদিন শত শত শ্রমিক ও অন্যান্য লোকজন কাজ করছে, বহু ট্রাক কনটেইনার নিয়ে আসা যাওয়া করছে, আর সংশ্লিষ্ট তদারকি প্রতিষ্ঠানের কর্তারা ’নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে’। বিস্ফোরক অধিদপ্তর, কেমিক্যাল রাখার বিষয়ে তাদের অনুমতি নেওয়া হয়নি বলে দায় সেরেছে! পরিবেশ অধিদপ্তরের বক্তব্যও একই রকম! আসলে তারা সবই জানে। অবৈধ অর্থ আয়ের জোরে তারা দেখেও এতোদিন দেখেনি! তাই তাদের এ ঘটনায় আসামি করা অযৌক্তিক হবে না! আর কাস্টমস ও বন্দর কর্মকর্তারাতো সব জেনে শুনেও তাদের সঙ্গে কনটেইনার লোড আনলোডের কাজ করে আসছেন। তাই তারাও সব জানেন। তারপরও ওই অবৈধ অর্থের কাছে নতজানু।
বিস্ফোরক অধিদপ্তর ও পরিবেশ অধিদপ্তরের থেকে অনুমতি না নেওয়া হলেও এখানে কি হচ্ছে তা যদি তারা সরেজিমনে দেখত, তাহলে হয়ত এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটত না। একইভাবে কাস্টমস ও বন্দর কর্তারা যদি তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করত তাহলে কি এমন হত?
আর এই বিএম কনটেইনার টার্মিনালের মালিক মুজিবর রহমানসহ অন্যান্যরা ঘটনাস্থলেই আসেনি। যারা ছিল তারাও সটকে পরেন। তারা যদি জানাত সেখানে কি ধরনের কেমিক্যাল আছে তাহলে ফায়ার সার্ভিসের ৮ জনসহ ৫০ জন মানুষের মৃত্যু হয়ত হতো না। মালিকরা ভিডিও বার্তা দিয়ে দায় সেরেছে। বলা হচ্ছে, মুজিবর রহমান সরকারি দলীয় নেতা ও স্থানীয় একটি পত্রিকার মালিক সম্পাদক হওয়ায় এই টার্মিনালে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার বালাই ছিল না। ক্ষমতার দাপট ও অবৈধ অর্থের কাছে সব নিয়ম কানুনকে তিনি বন্দি করে রেখেছিলেন। আর তার খেসারত দিতে হলো হতাহতদের, আমদানি-রপ্তানির জন্য সেখানে জমা কনটেইনারের মালামালের ব্যবসায়ীদের ও এলাকাবাসীকে। বলা হচ্ছে, এই অগ্নিকাণ্ডের প্রচন্ড বিস্ফোরণে ওই এলাকার ৫ কিলোমিটারের মধ্যে সব স্থাপনা কমবেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাতাসও হয়ে পড়েছে বিষাক্ত।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হতাহতের স্বজনদের আহাজারি যেন দূরে থাকাদেরও বুকে এসে বিঁধেছে। ফেসবুকে লাইভ করতে গিয়ে বিস্ফোরণে উড়ে যাওয়া, বাবা মাকে শেষ কথা বলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া—এরকম আরও অনেক মানবিক বিপর্যয় সবাইকে বিপন্ন, গভীর শোকাচ্ছন্ন করে দিয়েছে। এমনই হৃদয় বিদারক ঘটনা আর কত দেখবে এই বাংলাদেশ?
আসলে অবৈধ অর্থের বিলাসী জীবন যারা করেন, তারাতো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনো না কোনোভাবে অন্যের জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। আর এই অবৈধ অর্থের সব উৎস বন্ধ করা গেলেই হয়ত জীবনের অকাল প্রয়াণ রেহাই পাবে! সে আশা কি আমরা করতে পারি?
লেখক: ইব্রাহিম আজাদ, লেখক ও সাংবাদিক।
আরএ/