দ্রব্যমূল্য, ভোক্তা অধিকার এবং ইসির সংলাপ
আজ ভোক্তা অধিকার দিবস। আমরা ভোক্তা। আমাদের কিছু অধিকার আছে। আসলেই কি আমাদের কোনো অধিকার আছে? আমাদের অধিকার নিয়ে কেউ ভাবে? আমার মনে হয়, ভোক্তা হিসেবে এই দেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। দ্রব্যমূল্যের অবস্থা দেখলে মনে হয় না, ভোক্তা অধিকার বলে কিছু আছে। তারপরও দিবস পালনের খাতিরে বলতেই হয়, ব্যবসায়ী ভাইয়েরা, অন্তত আজকের দিনটিতে আমাদের অধিকারের কথা মনে রাখুন। আপনারা যারা ব্যবসার নামে অতি মুনাফা খাচ্ছেন, তারা একটু সতর্ক হোন। আজকের দিনে আমাদের মত নগন্য ভোক্তাদের ঠকাবেন না। আর সামনে রমজান। আল্লাহকে ভয় করুন এবং রজমানে দ্রব্যমূল্য না বাড়িয়ে স্বাভাবিক রাখুন। অতি মুনাফা না করে সামান্য করুন। তাতে আল্লাহ তায়ালার রহমত আপনাদের ওপর বর্ষিত হবে।
২
আমাদের সামনে একটা নির্বাচন আছে। জাতীয় নির্বাচন। সেই নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্টুভাবে সম্পন্ন করতে হবে। যদিও অনেক মানুষ বিশ্বাসই করে না, এই দেশে আর কোনো দিন জাতীয় নির্বাচন খুব শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ হবে। নির্বাচন কমিশন কিংবা প্রশাসন কখনো নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবে না। কারণ, নির্বাচন কমিশন স্বাধীন না। যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক নির্বাচন কমিশন সেই সরকারের কথা শুনতে বাধ্য। তা না হলে বিপদে পড়তে হবে। জেনেশুনে কে বিপদে পড়তে চায়?
দেশের মানুষের ধারণা ভুল প্রমাণের জন্য কিছু একটা করতে হবে। সরকার অনেক চিন্তাভাবনার পর একটা পথ খুঁজে বের করল। সেই পথটি হলো নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে আইন প্রণয়ন। সেই আইন যেনতেন হলেও সমস্যা নেই। মানুষের মধ্যে এক ধরনের আস্থা তৈরি হবে। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোও আইনের ওপরই বেশি জোর দিল। অতঃপর একটি আইন প্রণয়ন করা হলো। দীর্ঘ ৫০ বছর পর জনগণ একটি নির্বাচন কমিশন আইন পেল। সেই আইনের আওতায় সরকার নির্বাচন কমিশন গঠন করেছে। নতুন নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যেই বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে সংলাপ শুরু করেছে। ইসির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা দেশের নাগরিক সমাজ, সাংবাদিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে সংলাপে বসবে। সবশেষে সংলাপ করবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে।
নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে ইসির করণীয় কী হবে তা বলবেন বিশিষ্টজনেরা। কিন্তু ইসি বিশিষ্টজনদের পরামর্শ কতটা কাজে লাগাতে পারবে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সংশয়ও আছে। বিরোধীদলের নেতা-কর্মীরা প্রতিনিয়ত বলে যাচ্ছেন, আওয়ামী লীগ সরকার তার দলীয় লোকদের নিয়ে ইসি গঠন করেছে। এই ইসির অধীনে তারা নির্বাচনে যাবেন না। কিন্তু নির্বাচনে না গেলে কী হবে? নির্বাচন কি থেমে থাকবে? বিগত নির্বাচনে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়নি। তাকে কে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে? বিএনপি নাকি দেশের জনগণ? অনেকে বলেন দেশের জনগণই বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে। কারণ সংসদে শক্তিশালী বিরোধীদল না থাকায় সরকার জনগণের সুখ-দুঃখের কথা ভাবে না।
দেশের স্বার্থেই আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হওয়া দরকার। দেশের মানুষ যেন শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে। এটা নিশ্চিত করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। তা নাহলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি মিলবে না। এই বার্তা সরকারের কাছেও রয়েছে। তাই সরকার চায়, সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক। জনগণও চায়।
৩
যে মুহূর্তে ইসি আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে সংলাপের আয়োজন করেছে; ঠিক সেই মুহূর্তেই দেশে এক ধরনের অস্বস্তিকর পরিবেশ বিরাজ করছে। টানা দুই বছর করোনার কারণে দেশের মানুষ চরম বিপদে আছে। সেই বিপদের মধ্যে আরও বড় বিপদ প্রায়শ মানুষকে হানা দিচ্ছে। দ্রব্যমূল্য লাগামহীন। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির দাম দফায় দফায় বাড়ানোর কারণে সংসার খরচ বেড়ে গেছে। পরিবহন খরচ বেড়েছে। ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ বেড়েছে। বেড়েছে বাড়িভাড়াও। এসব দেখার জন্য কেউ নেই।
দেশের কিছু লোভী, অতি মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা নানা কৌশলে ভোজ্যতেলসহ বিভিন্ন জিনিসপত্রের দাম কেবল বাড়াচ্ছেই। অনেকে অতি লাভের আশায় গুদামজাত করে রেখেছে। রজমানে আরও বেশি মুনাফা লুটবে। কিন্তু অতি লোভীদের কিছুই বলা হচ্ছে না। আসলে কিছু বলা যাচ্ছে না। বলতে গেলেই জোট বাঁধবে। সরকারকে আরও বেকায়দায় ফেলবে। অথচ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রজমানে ব্যবসায়ীরা জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে দেয়। রজমানে তারা মুনাফা কম করে। আমাদের দেশেই কেবল উল্টো চিত্র। অথচ ধর্মীয় প্রসঙ্গ এলেই আমরা কথায় কথায় সৌদিআরবের প্রসঙ্গ টানি। কিন্তু সৌদি ব্যবসায়ীদের রীতিনীতি মানি না।
৪
জনগণের চাপে হোক আর স্বেচ্ছায় হোক, সরকার টিসিবির পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি শুরু করেছে। টিসিবির লাইন প্রতিনিয়ত দীর্ঘ হচ্ছে। লাইনে কেবল নিম্ন বা নিম্নমধ্যবিত্তই নয়, মধ্যবিত্তরাও দাঁড়াচ্ছে। আসলে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ টিসিবির পণ্য বাজারদামের চেয়ে কিছুটা সহনীয়। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের তাল মিলাতে পারছে না মধ্যবিত্তশ্রেণি। দেশের নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষেরা অনেকদিন ধরেই কষ্ট সহ্য করে আসছে। তাদের এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। বিগত দুই বছরে করোনা মহামারির কারণে অসংখ্য মানুষ চাকরি হারিয়ে গ্রামে চলে গেছে। গ্রামে গিয়েও তারা কঠিন বিপদে পড়েছে। বাঁচা-মরার লড়াইয়ে অসংখ্য মানুষ আজ পর্যুদস্ত।
টিসিবির লাইন আর বেশি যেন দীর্ঘ না হয়। মানুষ যাতে স্বস্তিতে দিন কাটাতে পারে; সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে। সেজন্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনায় বসে হোক কিংবা চাপ দিয়ে হোক, দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানতেই হবে। তা নাহলে আগামী নির্বাচনে কঠিন চ্যালেঞ্জে পড়তে হবে। মনে রাখতে হবে, আমরা মানি আর না মানি, জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। ভোটের দিন জনগণ সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করলে সকল দম্ভ চূর্ণ হয়ে যাবে।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, ঢাকাপ্রকাশ ও সাহিত্যিক।