উপাত্ত সুরক্ষা আইনের খসড়ায় ভিন্নমত দমন পোক্ত করা হয়েছে: টিআইবি
উপাত্ত সুরক্ষা আইনের খসড়ায় সরকারি নজরদারি আর ভিন্নমত দমনের ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
পাশাপাশি দেশের ভেতরে উপাত্ত মজুতের অবিবেচনাপ্রসূত বিধান অপপ্রয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করবে এবং দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলে মনে করে সংস্থাটি।
সোমবার (১৭ এপ্রিল) টিআইবি কার্যালয়ে ‘উপাত্ত সুরক্ষা আইন, ২০২৩ (খসড়া): টিআইবির পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির পক্ষ থেকে এমন মতামত ব্যক্ত করা হয়।
টিআইবি বলছে, চলতি বছরের ১৪ মার্চ উপাত্ত সুরক্ষা আইন, ২০২৩ এর খসড়া অংশীজনের মতামতের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। টিআইবি গত ২৮ মার্চ ৪১টি সুনির্দিষ্ট সুপারিশ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বিবেচনার জন্য পাঠিয়েছে।
এটি আলোচ্য বিষয়ে প্রকাশিত চতুর্থ খসড়া। এর আগের প্রতিটি খসড়ার ওপর টিআইবি বিস্তারিত ব্যাখ্যাসহ মতামত দিয়েছে এবং দুই দফা সংবাদ সম্মেলেনের মাধ্যমে গণমাধ্যমের সামনেও তা তুলে ধরেছে।
খসড়া প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা চলমান আলোচনার বিভিন্ন পর্যায়ে টিআইবির বেশকিছু সুপারিশ মেনে নেওয়ার কথা জানিয়েছেন। তবে কতোগুলো সুপারিশ মেনে নেওয়া হলো, তার চাইতেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো, কোন সুপারিশগুলো পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
টিআইবি আরও জানায়, এই ধরনের আইনের ক্ষেত্রে আন্তজার্তিকভাবে স্বীকৃত নীতি হলো কেবলমাত্র একক ব্যক্তি (জীবিত ব্যক্তি) এর আওতায় আসবে। অথচ আলোচ্য খসড়াতে ‘ব্যক্তি’ অর্থে একক ব্যক্তির পাশাপাশি আইনগত ব্যক্তিসত্ত্বা, সংস্থা, অংশীদারি কারবার, কোম্পানি, সমিতি, করপোরেশন, সমবায় সমিতি, প্রতিষ্ঠান বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থাকেও এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ফলে উপাত্তধারী, নিয়ন্ত্রক, প্রক্রিয়াকারী এবং নজরদারির জন্য প্রস্তাবিত উপাত্ত সুরক্ষা এজেন্সি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। সবাই ‘ব্যক্তি’ হওয়ায়, ভিন্নভিন্ন প্রেক্ষিতে সুরক্ষা এজেন্সিসহ সবাই উপাত্তধারী, প্রক্রিয়াকারী ও নিয়ন্ত্রক হতে পারে। কার্যত ব্যক্তির সংজ্ঞার ব্যাপকতা আলোচ্য আইনটিকে একটি অবাস্তব অবস্থানে নিয়ে গেছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘ইতোপূর্বে টিআইবি উপস্থাপিত কোনো কোনো সুপারিশ বিবেচনায় নিলেও খসড়া আইনের মৌলিক ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্রসমূহে সরকার নিজের অবস্থানে অনড় রয়েছে, যা উদ্বেগজনক। বিশেষ করে এই আইনের মূল লক্ষ্য ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষার যে উদ্দেশ্য, তার পরিবর্তে এটিকে ব্যক্তিগত তথ্যের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রন ও নজরদারি প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের ব্যাপক সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। বৈশ্বিক চর্চা উপেক্ষা করে খসড়ায় এই আইনের মাধ্যমে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার মৌলিক অধিকার নিশ্চিতের পরিবর্তে লঙ্ঘনের সমূহ ঝুঁকি বর্তমান খসড়ায়ও রাখা হয়েছে’।
টিআইবি নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, ‘ব্যক্তিগত তথ্যের সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা ও প্রাধান্য অনুযায়ী বিন্যাসের অনুপস্থিতি ও এর ফলে এই আইনের যথেচ্ছ ব্যবহারের সম্ভাবনা যার উদাহরণ। সরকারি কর্তৃত্বাধীন তথ্য সুরক্ষা কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠার যে প্রস্তাব রাখা হয়েছে, তা স্বার্থের দ্বন্ধে দুষ্ট ও বৈশ্বিক চর্চার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। একইভাবে যে হারে এই আইনের অসংখ্য অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যার ক্ষমতা বিধি প্রণয়নের মাধ্যমে সরকারের হাতে একচ্ছত্রভাবে অর্পণ করা হয়েছে, তার ফলে সরকার চাইলে ইচ্ছে মতো মানুষের ব্যক্তিগত তথ্যের উদ্দেশ্যমূলক অপব্যবহার ও বাক্স্বাধীনতা ও ভিন্নমত দমন এবং নজরদারির জন্য এই আইনকে ব্যবহার করতে পারবে। এ সকল উদ্বেগ নিরসনে টিআইবি উপস্থাপিত সুপারশমালা বিবেচনায় নিয়ে খসড়াটি ঢেলে সাজাবার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই।’
ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার বিষয়টি নজরদারির জন্য সরকারের নিয়ন্ত্রণনের বাইরে একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের দাবি জানানো হলেও, আলোচ্য খসড়ায় উপাত্ত সুরক্ষা এজেন্সি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যার নিয়োগ দেবে সরকার। সরকার নিজেই যেখানে উপাত্ত ব্যবহারকারী ও প্রক্রিয়াকারী, সেখানে সরকার যে আইনটি যথাযথভাবে মানছে, সেটি আরেকটি সরকারি সংস্থা নিশ্চিত করবে, এমনটা ভাবা অবাস্তব। পাশাপাশি, দেশের সীমানার ভিতরে উপাত্ত মজুত করার বিধান রেখে কার্যত উপাত্তের ওপর নজরদারির ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা সরকারের হাতে রাখা হয়েছে। সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে থাকা উপাত্ত সুরক্ষা এজেন্সির প্রচণ্ড ক্ষমতা এবং এর বিপরীতে অপব্যবহার রোধের কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না থাকায়, আলোচ্য খসড়াটি নিশ্চিতভাবে জনগণের সংবিধানস্বীকৃত বাক্-স্বাধীনতা ও গোপনীয়তার অধিকার ক্ষুণ্ন করবে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও জনগণের ব্যক্তিগত যোগাযোগের ওপর সরকারের বিভিন্ন সংস্থার নজরদারি জোরদার হবে মন্তব্য করে টিআইবি বলছে, ছোট ও মধ্যম পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানের জন্য উপাত্ত স্থানীয়করণ ব্যয়বহুল হওয়ায় তারা প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়বে। পাশাপাশি সব পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানের ব্যবসার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ভোক্তার ব্যয়ও বাড়বে। নির্ভরযোগ্য গবেষণায় দেখা গেছে, উপাত্ত স্থানান্তরের উপর কী ধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হবে, তার ভিত্তিতে দেশের ডিজিটাল রপ্তানি ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। প্রবৃদ্ধির হার কমতে পারে ০.৫৮ শতাংশ এবং বিদেশি বিনিয়োগের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
এ ছাড়া, খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো কোম্পানি এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘঠনের ক্ষেত্রে কোম্পানির প্রত্যেক মালিক, প্রধান নির্বাহী...কর্মচারী বা প্রতিনিধি উক্ত অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবেন, যদি না তিনি প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে, সেই অপরাধ তার অজ্ঞাতসারে হয়েছে বা অপরাধ রোধ করার জন্য তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। এই ধারার মাধ্যমে ফৌজদারি আইনে অপরাধ প্রমাণের দায়সংক্রান্ত নীতির সরাসরি বিপরীত ব্যবস্থার প্রস্তাব করা হয়েছে।
আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মনজুর-ই-আলম বলেন, ‘নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করা সব প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যমসহ দেশি-বিদেশি সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের জন্য আইনগত ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধির প্রয়োগের বিধান রাখার কারণে এই ঝুঁকি কেবল আর্থিক দণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। এর ফলে কার্যত গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর শুধু কণ্ঠরোধ নয়, বরং পঙ্গু করে ফেলার ব্যবস্থা করা হয়েছে।’
টিআইবি মনে করে বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনরে সঙ্গে ধারাবাহিক মতবিনিময় চলমান রেখে আলোচ্য খসড়াটিকে আন্তর্জাতিকমানে উন্নীত করার উদ্যোগ অব্যাহত রাখবে কর্তৃপক্ষ।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান; উপদেষ্টা, নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের ও টিআইবির ডেটা প্রোটেকশন অফিসার ড. মো. তরিকুল ইসলাম। সংবাদ সম্মেলনে ‘উপাত্ত সুরক্ষা আইন, ২০২৩’ এর খসড়ার উপর টিআইবির পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন সংস্থাটির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মনজুর-ই-আলম।
আরইউ/এমএমএ/