গম কেনা নিয়ে টিআইবির বক্তব্য অসঙ্গতিপূর্ণ: খাদ্য মন্ত্রণালয়
বেশি দামে গম আমদানির বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তকে জনস্বার্থ পরিপন্থি উল্লেখ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) উদ্বেগ জানানোর পর প্রতিবাদ জানিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে সম্প্রতি টিএইবি’র ‘বেশি দামে গম আমদানি’ শিরোনামে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি খাদ্য মন্ত্রণালয়ের নজরে এসেছে। এখানে ভুল ও অসঙ্গতিপূর্ন তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে। জনমনে এ ধরনের প্রেস বিজ্ঞপ্তি বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। বিভ্রান্তি নিরসনে সঠিক তথ্য তুলে ধরা হলো।
টিআইবি’র বিবৃতি: গণখাতের ক্রয় আইন লঙ্ঘন করে রাশিয়া থেকে সরকারি পর্যায়ে (জিটুজি) পাঁচ লাখ টন গম কেনায় তৃতীয় একটি পক্ষকে যুক্ত করা হয়েছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা: গম ও চাল ক্রয়ের খাদ্য মন্ত্রণালয় গণখাতে ক্রয় আইনের কোনো লঙ্ঘন করেনি এবং কোনো তৃতীয় পক্ষকে ক্রয় প্রক্রিয়ায় যুক্ত করেনি। কয়েকটি গণমাধ্যমের সংবাদে যে তৃতীয় পক্ষের নাম বলা হচ্ছে, তাদেরকে রাশিয়া সরকারের পক্ষ থেকে লোকাল এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কোনো তৃতীয় পক্ষ বাংলাদেশের গম ক্রয়ের আলোচনা, মূল্যনির্ধারণ ও নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় সর্ম্পৃক্ত ছিল না।
জি টু জি কার্যক্রমে সরকার নির্ধারিত কমিটির সদস্যগণ (বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের) বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে আলোচনা প্রক্রিয়ায় অংশ নেন এবং ৪ ঘন্টাব্যাপী সভায় সর্বসম্মতভাবে ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেন। আলোচনা পর খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাবটি ক্রয় কমিটিতে যায়। ক্রয় কমিটি বিস্তারিত আলোচনার পর অনুমোদন দান করে। তারপর খাদ্য মন্ত্রণালয় কার্যাদেশ দেয়। এখানে তৃতীয় কোনো পক্ষের অংশগ্রহণের সুযোগ নেই।
টিআইবি’র বিবৃতি: বিশ্ব বাজারে দাম পড়তির দিকে থাকলেও ওই পক্ষের মাধ্যমে এই গম কেনা হচ্ছে বেশি দামে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা: বেশি দামে গম কেনা হচ্ছে তথ্যটি সঠিক নয়। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত গমের মূল্য উঠা-নামা করে। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আন্তর্জাতিক বাজার গম সংগ্রহ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে বাংলাদেশের গম আমদানির অন্যতম উৎস ভারত সরকারি ও বেসরকারি গম রপ্তানিতে নিষেদ্ধাঙ্গা আরোপ করায় গম আমদানি আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। অথচ সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম চালানো, নিয়মিত অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনা ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য গম সংগ্রহ অতীব জরুরি হয়ে পড়ে। গমের নিরাপত্তা মজুত যেখানে কমপক্ষে দুই লাখ মেট্রিকটন থাকার কথা তখন সেটা এক পর্যায়ে ১ দশমিক ২৫ লাখ মেট্রিক টনে নেমে আসে। বর্তমান মজুত ১.২২ লাখ মেট্রিকটন। পার্শ্ববর্তী কোনো দেশ গম রপ্তানি করে না। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা হতে জিটুজি প্রক্রিয়ায় গম সংগ্রহের চেষ্টা করা হয়েছে। প্রতি ক্ষেত্রে গমের দাম ৫ শ ডলারের উপরে হওয়ায় সরকার সেখান থেকে গম ক্রয়ে আগ্রহী হয়নি।
এ ছাড়া, অতিদ্রুত গম ক্রয়ের কোনো সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়নি। রাশিয়ার সঙ্গে গম আমদানির প্রথম আলোচনা শুরু হয় ২০২২ সালের ২৩ জুন। সে সময়ে রাশিয়া গম সরবরাহে সম্মত হয়নি তারপর সরকারি পর্যায়ে কূটনৈতিক যোগাযোগ শুর হয়। তিন মাসের সফল কূটনৈতিক যোগাযোগের পর রাশিয়ার বাংলাদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করেন। সাক্ষাতকালে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, অতিরিক্ত সচিব. খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত মহাপরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
এরপর ২৪ আগস্ট রাশিয়ার সঙ্গে গম আমদানির দ্বিতীয় নেগোসিয়েশন হয়। তখন রাশিয়ার গমের এফওবি মূল্য ছিল ৩৩০ মার্কিন ডলার। জাহাজ ভাড়া, লোডিং আনলোডিং, বার্থঅপারেটর হ্যান্ডলিং, ইনস্যূরেন্স ও লাইটেনিংসহ সর্বমোট মূল্য নির্ধারণ হয় ৪৩০ মার্কিন ডলার, যা যুক্তি সংগত ও সঠিক। সরকারি ক্রয় কার্যক্রমের সকল প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ক্রয় কার্যক্রম অনুমোদন দেওয়া হয়। উল্লেখ্য এক সঙ্গে ৫ লাখ মেট্রিকটন গম দেশে এনে সংরক্ষণ করার সক্ষমতা খাদ্য মন্ত্রণালয়ের নেই। অপর দিকে ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধের কারনে রাশিয়া থেকে গম আনার জাহাজও এ মুহূর্তে পর্যাপ্ত নয়। জাহাজ মালিকেরা এ অঞ্চলে জাহাজ দিতে চায় না। রাশিয়া হতে গম সরবরাহ কার্যক্রম ৪ মাস ধরে চলবে। তৃতীয় ও চতুর্থ মাসে গমের এফওবি মূল্য বৃদ্ধি পেলেও রাশিয়া চুক্তি মূল্যে গম সরবরাহ করবে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এক পূর্বাভাসে বলেছে আগামী বছর বিশ্বে খাদ্য ঘাটতি হতে পারে। সে কারণে জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে অগ্রিম সতর্কর্তা হিসেবে এক সঙ্গে ৫ লাখ টন গম ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর রাশিয়ার গমের এফওবি মূল্য ছিল ৩৩৪.২৫ মার্কিন ডলার। প্রতিনিয়ত গমের এফওবি মূল্য বেড়ে যাচ্ছে। আরও উল্লেখ করা যায় জিটুজি এর পূর্ববর্তী দুইটি আন্তর্জাতিক দরপত্রে গমের ক্রয়মূল্য ছিল যথাক্রমে ৪৭৬.৩৮ এবং ৪৪৮.৩৩ মার্কিন ডলার।
টিআইবি’র বিবৃতি: বিতর্কিত প্রডিনটর্গকে কার্যাদেশ দেওয়ার ঘটনায় আমরা হতবাক হয়েছি।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা: প্রডিনটর্গ রাশিয়ার গম রপ্তানির জন্য রাশিয়া সরকার কর্তৃক মনোনীত প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ সরকার প্রডিনটর্গকে মনোনীত করে নাই। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছর থেকে প্রতিষ্ঠানটি জিটুজি ভিত্তিতে বাংলাদেশে গম সরবরাহ করে আসছে।
টিআইবি’র বিবৃতি: মাত্র এক লাখ টন গম চুক্তি অনুয়ায়ী সরবরাহ করতে ব্যর্থ হওয়া প্রতিষ্ঠান, কোনো জাদুবলে পাঁচ লাখ টন গম সরবরাহের কাজ পেল।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা: রাশিয়া বাংলাদেশকে দীর্ঘদিন ধরে জিটুজি কার্যক্রমে অন্যান্য দেশের ন্যায় গম সরবরাহ করে আসছে। বিগত ২০২১-২০২২ অর্থবছরে প্রডিনটর্গ ৩ লাখ টন গম যথাসময়ে নিয়ম মাফিক বাংলাদেশকে সরবরাহ করেছে। ২০২০-২০২১ সালে করোনাকালে ২ লাখ মেট্রিকটন চুক্তিবদ্ধ ছিল। প্রতিকূলতার মধ্যে ও তারা ১ লাখ টন গম সরবরাহ করে। পূর্ববর্তী ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে প্রডিনটর্গ ২ লাখ টন গম বাংলাদেশকে সঠিককভাবে সরবরাহ করেছিল। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে এবং ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে প্রডিনটর্গ মোট ৪ লাখ মেট্রিকটন গম সঠিকভাবে সরবরাহ করেছে।
টিআইবি’র বিবৃতি: গমের বাড়তি দামের কারণেই সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ার অন্য একটি দেশ রাশিয়ার খাদ্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান প্রডিনটর্গের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা: বিশ্বের কোনো দেশ প্রডিনটর্গ এর সঙ্গে চুক্তি করে তা বাতিল করেছে কি না কিংবা কেন করেছে এর বিস্তারিত তথ্য খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে নেই।
খাদ্য মন্ত্রণালয় মনে করে সঠিক তথ্য গোপন করে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠিয়েছে টিআইবি। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে এ ষড়যন্ত্র করছে তারা।
এসএম/এমএমএ/