শেখ হাসিনার সফর নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যম যা বলছে
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ৫ সেপ্টেম্বর তিন দিনের সফরে ভারতে যাচ্ছেন। সফর নিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, সফরকালে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা দুই নেতার প্রধান আলোচ্য বিষয়।
সফর নিয়ে ভারতের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা পিটিআই একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। পিটিআইয়ের করা সেই প্রতিবেদনটি, ডেকান হেরাল্ড, দ্যা টেলিগ্রাফসহ প্রভাবশালী অনলাইন ও দৈনিক পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে প্রকাশ করা হয়েছে। এ ছাড়া ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, দ্যা প্রিন্ট, জিনিউজ, এশিয়ান নিউজ নেটওয়ার্ক নিজস্ব সংবাদ প্রকাশ করেছে।
সফর নিয়ে বিস্তারিত সংবাদ প্রকাশ করেছে কলকাতার বিখ্যাত বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, সংবাদ প্রতিদিনসহ বেশি কিছু গণমাধ্যমও। সফর উপলক্ষে সম্প্রতি এসব প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
পিটিআইয়ের ‘৫ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর ভারত সফরে যাচ্ছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা‘ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুই প্রধানমন্ত্রীর মূল আলোচনা হতে পারে প্রধানত দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিরক্ষা সহযোগিতা ও স্থিতিশীলতা। পিটিআই বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সূত্রের বরাত দিয়ে বলছে, মুলতবি ও রুটিন দ্বিপাক্ষিক বিষয় ছাড়াও শ্রীলঙ্কা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দুই প্রধানমন্ত্রীর আলোচনার সময় দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিরক্ষা সহযোগিতা ও স্থিতিশীলতা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হতে পারে।
বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা
পিটিআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতীয় অস্ত্র বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীকে আরও সজ্জিত করতে পারে এমন জল্পনা-কল্পনার মধ্যে গত মাসে ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল মনোজ পান্ডে যখন বাংলাদেশ সফর করেন তখন দ্বিপাক্ষিক প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়টি নজরে আসে।
এ ছাড়া ভারতের প্রভাবশালী অনলাইন সংবাদপত্র দ্যা প্রিন্টের খবরেও বলা হয়, বাংলাদেশ যেহেতু সামরিকভাবে নিজেদের শক্তিশালী করার পরিকল্পনা করছে, ভারত সে দেশের কাছে আরও বেশি সংখ্যক অস্ত্র ও সরঞ্জাম বিক্রি করতে চায়।
সূত্র জানায়, ২০১৬ সালে বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে যেসব সাবমেরিন কিনেছিল সেগুলো কাজে লাগেনি। সুতরাং, বাংলাদেশ ফ্রান্স ও ভারতের মতো দেশ থেকে প্রতিরক্ষা সামগ্রীর জন্য তথ্য সংগ্রহ করছে।
বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা নিয়েই মূল আলোচনা হবে বলে জানিয়েছে ভারতের প্রভাবশালী সংবাদপত্র ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। পত্রিকাটি সূত্রের বরাত দিয়ে বলছে, বাণিজ্য, সংযোগ ও প্রতিরক্ষা সম্পর্ক দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনায় প্রাধান্য পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ ছাড়াও, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন এবং উন্নয়ন সহযোগিতাও আলোচনার অংশ হবে। ৬ সেপ্টেম্বর দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকটি হবে।
পানিবণ্টন, কানেকটিভিটি ও সীমান্ত
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, ভারতের ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে নেপাল ও ভুটানে মোটরচালিত যানবাহন চলাচলের পাশাপাশি অভিন্ন তিস্তার পানি ও অন্যান্য আন্তঃসীমান্ত সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে চায় ভারত। ঢাকা রেল যোগাযোগ বাড়াতে এবং দুই দেশের মধ্যে আরও তিনটি ট্রেন পরিষেবা পুনরুদ্ধার করতে ইচ্ছুক। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ পর্যন্ত ব্যবহৃত পুরোনো ট্র্যাকগুলিকে পুনরায় চালু করতে চায় বাংলাদেশ।
অন্যদিকে, ভারত স্পষ্টতই মংলা সমুদ্রবন্দরসহ দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলাদেশের সঙ্গে দেশের অন্যান্য অংশের সংযোগ স্থাপনকারী সম্প্রতি নির্মিত পদ্মা সেতুর সুবিধা পেতে কানেক্টিভিটি সমস্যা এবং বিশেষ করে ট্রানজিট সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী।
বাংলাদেশের নির্বাচন ও হাসিনার ভারত সফর
পিটিআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈদেশিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, যে ২০২৩ সালের বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনের আগে হাসিনার ভারত সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। ভারতের সঙ্গে সমস্যাগুলো কিছু পরিমাণে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে এবং পাশের দরজার প্রতিবেশীর সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সমাধান করতে পারলে নির্বাচনে হাসিনার সুবিধা হবে।
ভারতের অনলাইন সংবাদপত্র দ্যা প্রিন্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী বছরের নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে ভারতের সমর্থন আদায় করা তার সফরের আরেকটি কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে। বাংলাদেশে ২০২৩ সালের সাধারণ নির্বাচন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য একটু কঠিন হবে বলে মনে করা হচ্ছে এবং এমন একটি সময়ে তিনি আসছেন যখন দেশটি গণতান্ত্রিক তার ভাবমূর্তি টিকিয়ে রাখার জন্য লড়াই করছে।
সূত্রের মতে, এই সফরে শেখ হাসিনা নির্বাচনী প্রচারে নিজেকে নিমজ্জিত করার আগে ভারতের সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন।
এদিকে ঢাকা বেইজিংয়ের দিকে ঝুঁকবে না- তা নিশ্চিত হতে চায় নয়াদিল্লি। দ্যা প্রিন্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দরে চীনা 'গুপ্তচর' জাহাজ ইউয়ান ওয়াং-৫ ডকিংয়ের বিষয়ে নয়াদিল্লি অত্যন্ত সতর্ক হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশকে ভারতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলে মনে করা হয়, নয়াদিল্লি নিশ্চিত করতে চায় যে এটি বেইজিংয়ের দিকে ঝুঁকবে না।
রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুটি বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় ঢাকা ও বেইজিংয়ের মধ্যে সম্পর্ক আগামী মাসগুলোতে কিছুটা বড় গতি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। হাসিনা সরকার চায় চীন মিয়ানমারকে শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে চাপ দিক।
এই মাসের শুরুর দিকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় বেইজিং বাংলাদেশকে তার "দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত অংশীদার" হিসেবে উল্লেখ করেছিল এবং ঢাকা পুনর্ব্যক্ত করেছিল যে চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেলেও বাংলাদেশ 'এক চীন' নীতি অনুসরণ করে।
এই অঞ্চলে চীনের বর্ধিত অংশীদারী নয়াদিল্লির উদ্বেগের একটি বিষয় যা দুই নেতার আলোচনার সময় একটি পরোক্ষ ইস্যু হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে।
মিয়ানমারের নিপীড়ন এড়াতে দেশটিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হওয়া ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের প্রচেষ্টার পরিপূরক হিসেবে বাংলাদেশও মূলত চীনের ওপর নির্ভরশীল।
কর্মকর্তাদের মতে, হাসিনা ও মোদি যৌথভাবে বাংলাদেশে একটি যৌথ উদ্যোগ হিসেবে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড কর্তৃক স্থাপিত ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র উদ্বোধন করতে পারেন।
দিল্লিতে হাসিনা-মমতা বৈঠক হতে পারে
ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের বৈঠক হতে পারে। এমন খবর প্রকাশ করেছে আনন্দবাজার পত্রিকা, সংবাদ প্রতিদিনসহ কলকাতার কয়েকটি গণমাধ্যম।
আনন্দবাজারের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়কে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন তিনি দিল্লি আসছেন এবং তার সঙ্গে দেখা হবে।
ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, শেখ হাসিনা ভারতে আসার ঠিক আগে, ২৪ আগস্ট নয়াদিল্লিতে যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক হয়েছে। প্রায় ১২ বছর পর মন্ত্রী পর্যায়ের এই দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের আয়োজন হলো।
হাসিনার সফরের আগে এই বৈঠক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বয়েছে ৫৪টি অভিন্ন নদী। তার মধ্যে ৬টি নদীর পানিবণ্টন এবং বিভিন্ন দিক নিয়ে ‘ইতিবাচক’ আলোচনা হয়েছে। তবে তিস্তা নিয়ে কোনো অগ্রগতি এই বৈঠকে হয়নি।
প্রসঙ্গত, ২০১০ সালে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি প্রায় স্বাক্ষরই হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় বেঁকে বসায় তখন আর চুক্তিটি হয়নি।
আজমির শরীফে নামাজ পড়বেন হাসিনা
ভারতের আরেক প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম জিনিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরকালে আজমির শরীফে নামাজ আদায় করবেন। হাসিনা এর আগেও ২০১৭ সালে আজমীরে গিয়েছিলেন এবং খাজা মঈনুদ্দিন চিশতির মাজারে চাদর দিয়েছিলেন। তিনি ২০১০ সালেও মাজারটি পরিদর্শন করেছিলেন, যখন তিনি দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হন।
এনএইচবি/এসএন