চা শ্রমিকদের আন্দোলনে বিশিষ্ট নাগরিকদের সংহতি
চা শ্রমিকদের আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন দেশের ২৭ জন বিশিষ্ট নাগরিক। বিবৃতিতে তারা বলেন, বর্তমান ১২০ টাকা মজুরি কিংবা এর সাথে আরও ১৪ টাকা যোগ করে ১৩৪ টাকা বিদ্যমান উচ্চমূল্যের বাজারে কখনই জীবনযাপনের উপযোগী মানবিক মজুরি হতে পারে না। চা বাগান শ্রমিকদের জীবনযাপন উপযোগী 'মানবিক মজুরি' ঘোষণা করার দাবি জানান তারা।
বিবৃতিতে বিশিষ্ট নাগরিকরা বলেন, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন অবসানের প্রায় ৭৫ বছর পরও বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশে ঔপনিবেশিক নীতিতেই চা বাগানগুলো পরিচালিত হচ্ছে, যা কখনই মানবিক হতে পারে না। একজন শ্রমিক যে হারে মজুরি পাচ্ছেন, তা দিয়ে শ্রমিক ও তার উপর নির্ভরশীল পরিবারের ভরণপোষণ করা যায় না। অথচ শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবিকে অযৌক্তিক উল্লেখ করে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের রেশন সুবিধা এবং ২০ কেজির বেশি চা পাতা তুলতে পারলে বর্ধিত মজুরি দেওয়ার বিষয়টিকে উচ্চকিত করে প্রচার করছেন। যদিও এই রেশন ও বর্ধিত মূল্য পরিশোধে শুভঙ্করের ফাঁকির বিষয়টি বুঝতে কারও অসুবিধা হয় না। কেননা বহুদিন ধরেই শ্রমিকরা অভিযোগ করে আসছেন যে, রেশনে যে চাল বা আটা দেওয়া হয় তা কখনই ঘোষিত পরিমাপের পরিমাণ পাওয়া যায় না। এমনকি একজন শ্রমিকের পক্ষে সারা দিনে ২০ কেজি পাতা তুলতে পারাটা সহজ কাজ নয়, কালেভদ্রে এক-দুইজন শ্রমিক ২০ কেজির চেয়ে বেশি পাতা তুলতে পারেন। এই বাড়তি পাতার জন্য যে মূল্য পরিশোধ করা হয়, তা কেজিপ্রতি নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কম। অন্যদিকে বেশি সংখ্যক শ্রমিকই ২০ কেজি পাতা তুলতে পারেন না। এক্ষেত্রে যে পরিমাণ কম তোলা হয় এবং তার বিপরীতে যে টাকা দৈনিক মজুরি থেকে কেটে নেওয়া হয়, সেটি বাড়তি পাতার জন্য প্রদেয় মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি। এই শুভঙ্করের ফাঁকির বিষয়টি মালিকপক্ষ বরাবরই এড়িয়ে যান।
তারা বলেন, আমরা মনে করি, প্রায় ২০০ বছর আগে যাত্রা শুরু করা এই শিল্পের শ্রমিকরা এখনো একইভাবে শোষণের শিকার হচ্ছে, যা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। এজন্য রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে কৃষক ও শ্রমিকের মুক্তির কথা বলা হয়েছে। সে অনুযায়ী চা বাগানের শ্রমিকদের সব ধরনের শোষণ থেকে মুক্তির জন্য রাষ্ট্রকেই উদ্যোগ নিতে হবে। শ্রমিকের মৌলিক প্রয়োজনের যোগান নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য বাগান শ্রমিকদের জীবনযাপনের উপযোগী মানবিক মজুরি নিশ্চিতে রাষ্ট্রকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
চা বাগানে ঔপনিবেশিক আমলের দাসপ্রথা বিদ্যমান। ফলে এখানে বংশ পরম্পরায় শ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত হওয়াটাই যেন স্বাভাবিকতা পেয়েছে। বাগান শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা বঞ্চনার ব্যবস্থাপনা এই পরম্পরাকে টিকিয়ে রাখছে। এখানকার শ্রমিক ও তার পরিবার-পরিজন প্রয়োজনীয় খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যা সভ্য সমাজে কাম্য হতে পারে না। আমাদের সামনে একটি বিষয় স্পষ্ট, চা বাগানের শ্রমিকদের মৌলিক প্রয়োজন মেটানো এবং পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনকে রাষ্ট্র তার অন্যতম কর্তব্য হিসেবে গণ্য করেনি, যা বাগান শ্রমিকদের প্রতি রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক আচরণের উৎকট প্রকাশ। এই বৈষম্য দূর করতে হবে, যেখানে রাষ্ট্রের কার্যকর ভূমিকা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই।
আমরা বিশ্বাস করি, চা বাগানের শ্রমিকরা ৩০০ টাকা মজুরির যে দাবি তুলেছেন, তা বিদ্যমান বাজার মূল্যের তুলনায় কম। মৌলিক প্রয়োজন পূরণ, পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও প্রত্যাশিত জনস্বাস্থ্য সেবা প্রাপ্তিতে সক্ষম করে তুলতে তথা মানব অস্তিত্বের সুরক্ষায় চা বাগান শ্রমিকদের জন্য জীবনযাপন উপযোগী 'মানবিক মজুরি' ঘোষণা এবং বাজার মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানে মজুরি বৃদ্ধির স্থায়ী কাঠামো গড়ে তোলাসহ চা বাগান শ্রমিককে শ্রম আইনের আওতায় নিতে রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা করবে।
উল্লেখ্য, গত ৯ আগস্ট থেকে চা বাগানের শ্রমিকরা ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে আন্দোলন করছেন। সম্প্রতি ত্রিপক্ষীয় সভায়ও বিষয়টি সুরাহা হয়নি। মালিকপক্ষ শ্রমিকদের দাবির বিপরীতে মাত্র ১৪ টাকা মজুরি বৃদ্ধিতে রাজি হয়েছে।
বিবৃতিদাতারা হলেন- ঐক্য ন্যাপ সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল,সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য রামেন্দু মজুমদার, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ও সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ডা. সারওয়ার আলী, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ বিরোধী মঞ্চের সদস্য সচিব ড. নুর মোহাম্মদ তালুকদার, বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশ গুপ্ত, মহিলা পরিষদের সভাপতি, ডা. ফওজিয়া মোসলেম, বাংলাদেশ কৃষক সমিতির সভাপতি এস এম এ সবুর, মানবাধিকার কর্মী খুশী কবির, গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল বারী , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক সালেহ আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জোবায়দা নাসরিন, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী পারভেজ হাসেম, জাতীয় শ্রমিক জোটের কার্যকরী সভাপতি আবদুল ওয়াহেদ, সমাজকর্মী রাজিয়া সামাদ ডালিয়া, নাগরিক উদ্যোগের নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন, গবেষক ও সংস্কৃতি কর্মী ড. সেলু বাসিত, শ্রমিক সংগঠক আব্দুর রাজ্জাক, গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক অ্যাডভোকেট জীবনানন্দ জয়ন্ত, সংস্কৃতিকর্মী এ কে আজাদ, অলক দাস গুপ্ত, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের তথ্য ও প্রচার সম্পাদক দীপায়ন খীসা, মানবাধিকার কর্মী আবদুল আলীম, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের কেন্দ্রীয় সদস্য বিভূতী ভূষণ মাহাতো এবং বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি আবদুল মোতালেব জুয়েল।
এনএচইবি/এসজি/