ফিরে দেখা ২০২১
পুতিন যেখানে সবকিছুর ঊর্ধ্বে
সম্প্রতি ইউক্রেন সীমান্তে লক্ষাধিক সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়ে রাশিয়া অনেকটা প্রত্যক্ষভাবেই পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোকে যুদ্ধের হুমকি দিচ্ছে। আর এর মূলে রয়েছে–রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা সংহত করার প্রচেষ্টা। পুতিন সংবিধান সংশোধন ও আইন করে আজীবন ক্ষমতাসীন থাকার পথ নিশ্চিত করেছেন। কার্যত সেখানে রাষ্ট্র, সরকার ও পুতিন হয়ে উঠেছে এক অবিচ্ছেদ্য সত্তা।
ভিন্নমত দমন
ক্ষমতার পরিধি বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ভিন্নমত দমনেও একের পর এক সিদ্ধান্ত ও বাস্তবায়নের প্রতিফলন দেখা যায়। পুতিনের কঠোর সমালোচক আলেক্সেই নাভালনির ওপর বিষ প্রয়োগ করা হয় গত বছরের ২০ আগস্ট। ফলে সাইবেরিয়া থেকে আকাশপথে মস্কো যাওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। নাভালনিকে মস্কো শহরের একটি হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখান থেকে তাকে জার্মানিতে নেওয়া হয় চিকিৎসার জন্য।
পরে জার্মান সরকার জানায়, নাভালনির ওপর নোভিচক গ্রুপের নার্ভ এজেন্ট বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এজন্য রাশিয়া সরকারকে দায়ী করলেও, তারা এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
এ বছরের ১৭ জানুয়ারি জার্মানি থেকে সুস্থ হয়ে মস্কোর শেরেমেতিয়েভো বিমানবন্দরে নামার পর ৪৪ বছর বয়সী নাভালনিকে আটক করে রুশ পুলিশ। এর পর থেকে কারাগারেই রয়েছেন তিনি।
কর্তৃত্ববাদে আটক মিডিয়া
ক্ষমতা কঠোরভাবে সংহত করতে মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ অনেকটা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। ২০১২ সালের ‘বিদেশি চর’ আইন সংশোধনের মাধ্যমে বিদেশি ও মুক্ত সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, সম্প্রতি এর সেন্সরশিপের আওতা ভয়াবহ মাত্রায় বাড়ানো হয়েছে। ২০১৯ সালে আইনটি আবারও সংশোধন করা হয়। এবার শুধু প্রতিষ্ঠানই নয়, ব্যক্তিকেও এর আওতায় আনা হয়। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে তিন সাংবাদিক, একজন শিল্পী-অ্যাকটিভিস্ট ও ৭৯ বছর বয়সী মানবাধিকারকর্মী লেভ পোনোমারিয়ভকে এ আইনে অভিযুক্ত করা হয়। এর আগে লেভের গড়ে তোলা এনজিও ‘ফর হিউম্যান রাইটস’-এর কার্যক্রম বন্ধ করা হয়।
চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি প্রচারমাধ্যম আরএফই/আরএলকে দেড় লাখ ডলার জরিমানা করা হয়। মূলত নাভালনির হত্যাচেষ্টা, কারাগারে বন্দি রাখা এবং এ নিয়ে গড়ে উঠা আন্দোলন ও তা দমন নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জন্যই প্রতিষ্ঠানটিকে ‘বিদেশি চর’ আইনে অভিযুক্ত করা হয় বলে মনে করা হচ্ছে।
মিডিয়া বন্দি করার ফলে তথ্যের ইন্টারনেটভিত্তিক উৎসের ওপর রুশদের আস্থা পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। রাশিয়ার ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীদের ৮২ শতাংশই সংবাদ পেতে ইউটিউবে চোখ রাখছেন। আলেক্সেই নাভালনি খুব ভালো করেই জানেন, রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত টিভি চ্যানেলে তার খবরাখবর আসার সুযোগ নেই। তাই দুটি ইউটিউব চ্যানেল খুলে তাতে নিজের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রচারণা শুরু করেন। আর এতে ব্যাপক সাড়া পান তিনি।
সাংবিধানিক কর্তৃত্ববাদ
চলতি বছরের এপ্রিলে প্রেসিডেন্টের মেয়াদ সংক্রান্ত এক নতুন আইনে পুতিন স্বাক্ষর করেন। নতুন আইনের ফলে পুতিন চলতি মেয়াদ শেষ হওয়ার পর নির্বাচনের মাধ্যমে আরও দুই দফা প্রেসিডেন্ট পদে থাকার সুযোগ পাবেন।
আইন অনুযায়ী, পরপর দুই মেয়াদের বেশি কেউ ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না। ২০২৪ সালে পুতিনের চলতি শাসনামল শেষ হবে। ওই আইন সংশোধন না হলে পরের মেয়াদে তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারতেন না। তবে এই আইন ও গত বছরের সংবিধান সংশোধনীর ফলে এখন ২০২৪ সাল থেকে আবার নতুন করে নির্বাচনী মেয়াদের গণনা শুরু হবে। অর্থাৎ, ২০৩৬ সাল পর্যন্ত রাশিয়ায় ক্ষমতার শীর্ষে থাকার ব্যবস্থা পোক্ত করেছেন পুতিন। তাই ধরে নেওয়া যায়, আজীবন প্রেসিডেন্ট পদে বহাল থাকছেন পুতিন।
এর আগে ২০১৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে পুতিন সংবিধান সংশোধনের ঘোষণা দেন। এরপর গত বছরের ২০ জানুয়ারি তিনি পার্লামেন্টের নিম্ন কক্ষ ডুমায় সংশোধনী প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন। ওই প্রস্তাব অনুযায়ী, সংবিধানের ১৪টি ধারায় পরিবর্তন আনা হয়। প্রস্তাবটি উত্থাপনের সময়ই পুতিন গণভোট আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। গণভোটের মাধ্যমে এর স্থায়ীকরণ নিশ্চিত করা হয়।
গত বছর সপ্তাহব্যাপী (২৫ জুন থেকে ১ জুলাই) চলা ওই গণভোটে অংশগ্রহণকারী ভোটারদের প্রায় ৭৮ শতাংশ সংবিধান সংশোধনের পক্ষে মত দেন বলে জানায় রাশিয়ার নির্বাচন কমিশন। ওই গণভোটে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ উঠে।
সংবিধান সংশোধনে প্রধানভাবে যে বিষয়গুলো যুক্ত হচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে–সাংবিধানিকভাবে ঈশ্বরে বিশ্বাস করাকে স্বীকৃতি; সমলৈঙ্গিক বিয়ে নিষিদ্ধ; রাশিয়াজুড়ে রুশ ভাষা ও ইতিহাসের বিকাশে সাংবিধানিক স্বীকৃতি; আন্তর্জাতিক আইনের ওপর রাশিয়ার আইনকে প্রধান্য দেয়া; সরকারি কর্মচারীদের অন্য দেশের নাগরিকত্ব থাকার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা; প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হতে হলে নির্বাচনের আগে অন্তত ২৫ বছর রাশিয়ায় বসবাস করার বাধ্যবাধকতা, আগে এটি ছিল ১০ বছর।
সংশোধনীতে স্টেট সিকিউরিটি কাউন্সিলকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এ সংস্থাটিকে ‘পুতিনের মিনি সরকার’ বলে মনে করা হচ্ছে। যা কাজ করবে রাষ্ট্রের মাঝে রাষ্ট্র হিসেবে।
ওয়েবেও খড়গ
কর্তৃত্ববাদী কাঠামোর মূল বৈশিষ্ট্যই হলো তথ্যপ্রবাহকে সীমিত করা। ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ জরুরি হয়ে পড়ে পুতিনের জন্য। সরকারবিরোধী যে কোনো তথ্যকে ‘ফেক নিউজ’ বলে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রীয়, সরকারি বা সরকার-সমর্থিত মিডিয়া ও ইন্টারনেটে ব্যাপক প্রপাগান্ডা তো চলছেই।
বছর দুয়েক আগে রাশিয়ায় ফেক নিউজ প্রতিরোধে ‘ডিজিটাল সার্বভৌমত্ব’ শীর্ষক নতুন আইন পাস হয়। এই আইনের আওতায় যে তথ্যকে সরকারের কাছে মিথ্যা বলে মনে হবে, তা নিষিদ্ধ করে দেওয়া যাবে। এর শাস্তি হিসেবে চার লাখ রুবল (রাশিয়ার মুদ্রা) পর্যন্ত জরিমানা করা যাবে। মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর অভিযোগ তুলে যে কোনো ওয়েবসাইট ব্লকও করে দিতে পারবে সরকার। এখন পর্যন্ত লক্ষাধিক ওয়েবসাইট কালো তালিকাভুক্ত করেছে রুশ কর্তৃপক্ষ। রুশ তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানায় ঢোকানো হচ্ছে পুতিনের অনুসারীদের। ধীরে ধীরে এগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয়া হচ্ছে সরকারের হাতে।
সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ আন্দ্রেই সোলদাতোভ বলেন, ‘কোনো বিদেশি হুমকি বা ফেসবুক, গুগল ঠেকাতে এই আইন করা হয়নি। ওই কাজ আগের আইনেই করতে পারে রুশ সরকার। বেসামরিক বিক্ষোভের সময় কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় ইন্টারনেটের পুরো ট্রাফিক সিস্টেমই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে এই আইনের আওতায়। ফলে সরকারবিরোধী প্রচার সহজেই শনাক্ত করে দমন করা যাবে।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের পথেই হাঁটতে চাইছে রাশিয়া। তবে রাশিয়ার ক্ষেত্রে সব বন্ধ রাখাটা প্রায় অসম্ভব। অভিযুক্তদের আইনি ও সামাজিকভাবে হেনস্থা করাও নিয়ন্ত্রণের একটি বড় মাধ্যম, যা ব্যাপকহারে জনগণের মধ্যে সেলফ সেন্সরশিপ আরোপ করছে।
যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায় উগ্র-জাতীয়তাবাদ
গত ২ ডিসেম্বর (বৃহস্পতিবার) সুইডেনে ইউরোপীয় নিরাপত্তা বিষয়ক এক বৈঠকে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেনের পাশে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট করেই বলেছেন, রাশিয়া তার ঘরের পাশে ন্যাটোর নতুন কোনো তৎপরতা কোনোভাবেই সহ্য করবে না। ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্তি এবং আশপাশের দেশগুলোতে ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপন প্রসঙ্গে রাশিয়া এই অবস্থা গ্রহণ করে।
লাভরভ বলেন, ‘ন্যাটো জোটের সামরিক অবকাঠামো রাশিয়ার সীমান্তে নিয়ে আসা হচ্ছে। রোমানিয়া এবং পোল্যান্ডে মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী ব্যবস্থা মোতায়েন করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি মধ্যপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ইউরোপে নিয়ে আসা হচ্ছে। যার অর্থ ইউরোপে সামরিক সংঘাতের দুঃস্বপ্ন পুনরায় ফিরে আসছে।’
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের মার্চে ক্রিমিয়া দখলে নেয় রুশ সেনারা। রাশিয়া ২০১৮ সালে দুই ভূখণ্ডকে বিচ্ছিন্নকারী ক্রেচ প্রণালীর উপরে ব্রিজ নির্মাণ করে কুবান অঞ্চলের সঙ্গে ক্রিমিয়াকে সংযুক্ত করা হয়। এতে ওই অঞ্চলে রাশিয়ার নৈতিক এবং সামরিক অবস্থান পাকাপোক্ত করে। বর্তমানে ক্রিমিয়ায় রুশ নৌবাহিনীর কৃষ্ণসাগর বহরের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি রয়েছে।
জনগণের মধ্যে যে সমালোচনা, ভিন্নমত রয়েছে; সেসব ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে উগ্র-জাতীয়তাবাদ খুবই কার্যকর একটি পন্থা। ইউক্রেন বা ন্যাটোর বিরুদ্ধে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করা কার্যত পুতিনের পক্ষে, তথা উগ্রবাদী রুশ জাতীয়তাবাদে হাওয়া দেওয়ারই নামান্তর। আর এসবের মধ্য দিয়ে জনগণকে শাসন কাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন রেখে এক কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা গড়ে তুলছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, যে ব্যবস্থায় তিনি সব মতের ঊর্ধ্বে।
এসএ/