স্বাধীনতা পুরস্কার বিতর্কমুক্ত হলো, চলচ্চিত্র পুরস্কারের কী হবে?
সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কার ২০২২ আমির হামজা’র নাম ঘোষণার পর পরই শুরু হয় বিতর্ক। গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এ নিয়ে তুমুল বিতর্ক সৃষ্টি হলে আমির হামজা’র পুরস্কার বাতিল করে সরকার।
এ কারণে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়েন সাহিত্য অঙ্গনে সৃষ্টিশীল মানুষদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরাও।
আমির হামজার স্বাধীনতা পুরস্কার বাতিলের মাধ্যমে স্বাধীনতা পুরস্কার বিতর্ক ও কলঙ্কমুক্ত হলেও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার নিয়ে তৈরি বিতর্ক ও সমালোচনার শেষ হয়নি আজও। বরং দ্বিগুণ বেগে ছুটে চলছে বিতর্কের রথ। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে স্বাধীনতা পুরস্কারের মতো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও কি বিতর্ক ও কলঙ্ক মুক্ত হবে? নাকি নকল কথা ও সুরের গান গাওয়া শিল্পীর হাতেই উঠবে জাতীয় চলচ্চিত্রের মতো মর্যাদাপূর্ণ এই পুরস্কার?
এবারের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের বিতর্ক নিয়ে কিংবদন্তি গীতিকবি মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘যাদের সক্ষমতা আছে তারা অন্যের জিনিস গ্রহণ করে না। এগুলো হচ্ছে অক্ষমতার চূড়ান্ত অবক্ষয়। অক্ষম ব্যক্তিরাই এগুলো করছে। কিছুটা জুড়ে দেওয়া হলো অক্ষমতা। এদের মধ্যে সৃজনশীল বলতে কিছু নেই। কেন যে তারা এগুলো করছে, এর চেয়ে বেশি কিছু আমার বলার নেই। এটা অসাধু চিন্তা, অসাধু ব্যবসায়িক চিন্তা। আর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’
এ সম্পর্কে খ্যাতিমান গীতিকবি লতিফুল ইসলাম শিবলী বলেন, ‘যে কোনো জাতীয় পুরস্কার বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা উচিত। ভালো ও মান সম্মত গান না থাকলে সে বছর পুরস্কার না দেওয়া উচিত। বছর বছর পুরস্কার দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলে, পাঁচটা মানহীন গানের মধ্যে একটাকে বাছাই করে পুরস্কার দেওয়ার এই বাধ্যবাধকতা নিঃসন্দেহে জাতীয় পুরস্কারের মানকে ক্ষুন্ন করছে। আমার কথাটা গান ও সিনেমা উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।’
খ্যাতিমান গীতিকবি মিলন খান বলেন, ‘সম্পূর্ণ মৌলিক লেখা হওয়া উচিত, কাব্যিক শৈল্পিক নান্দনিক লেখা হওয়া উচিত। চুরি করা, ধার করা লেখা অবশ্যই নিন্দনীয়, অগ্রহণযোগ্য। আংশিক মেরে দেওয়া, জুড়ে দেওয়া লেখাও বর্জনীয়। এমন লেখার গান যদি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায় তাহলে এই পুরষ্কারের মান মর্যাদা ক্ষুন্ন হবে।
ধার করা লেখা দিয়ে কেউ পুরস্কার পেলে তা বাতিল করা উচিত এবং শান্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। পুরস্কার যেনো চর দখলের মতো জোর জবরদস্তি করে পাওয়া জিনিস না হয়। আমির হামজার স্বাধীনতা পদক বাতিল হয়েছে। চৌর্যবৃত্তির দায়ে অন্যান্য পুরস্কার বাতিল হবে কি?
স্বাধীনতা পুরস্কার বাতিলের পর খ্যাতিমান গীতিকবি মুন্সী ওয়াদুদ তার ফেসবুকে স্ট্যাটাসে লিখেন, তীব্র সমালোচনার মুখে মো. আমির হামজার স্বাধীনতা পুরস্কার বাতিল হবার পর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের বিতর্কিত গান সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু এখন!
একে তো গর্হিতভাবে একটি শব্দ বাদ দিয়ে ‘রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে চুপচাপ দু'লাইন চুরি’, উপরন্তু বাঙালির শিষ্টাচারের সঙ্গে যায় না, এমন ‘তুই-তোকারি মার্কা’ গানের জন্য
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, আমাদের সংগীত তথা সংস্কৃতির জন্য সত্যি অশনিসংকেত!
এবং সরকারের ভাবমূর্তির জন্যেও একটা চ্যালেঞ্জ। জাতীয় পুরস্কার রাজউকের প্লট বরাদ্দ নয়--এ বোধ আসবে কবে, পত্রিকার পাতায় এমন বিশ্লেষণেও দেখেছি বিদগ্ধজনের। অতএব সাধু সাবধান!’
এ নিয়ে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জুড়ি বোর্ডের অন্যতম সদস্য চিত্রনায়ক রিয়াজ বলেন, ‘দেখুন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার নিয়ে প্রতিবারই সমালোচনা হয়। এ নিয়ে তাই বিশেষ করে বলার কিছু নেই। তবে জুরিবোর্ড মানেই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শেষ কথা নয়। আমি বলব সবারই নিজের প্রতি সৎ হওয়া জরুরি। শিল্পচর্চায় সততা না থাকলে হয় না।’
এদিকে নকল কথা ও সুরের একটি গানে অল্প কয়েক লাইন গেয়ে কোনাল কীভাবে পুরস্কার পেল এই প্রশ্নে তুমুল বিতর্ক চলছে।
শুধু তাই নয়, এমন গানের জন্য কোনাল পুরস্কার পাওয়ায় বিষয়টি বেশ কিছু গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে।
সেখানে দাবি করা হচ্ছে, অনুমতি ছাড়াই একটি পুরনো জনপ্রিয় গানের লাইন ‘তুমি আমার জীবন আমি তোমার জীবন’ ব্রিজলাইন হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে কোনালের গাওয়া গানে। যা কপিরাইট আইনের লঙ্ঘন। এমন গানকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দিয়ে কপিরাইট আইনকে খাটো করা হয়েছে। সেই সঙ্গে অন্যের গান অনুমতি ছাড়া ব্যবহারেও উৎসাহিত করা হয়েছে।
‘অবুঝ হৃদয়’ সিনেমার ‘তুমি আমার জীবন আমি তোমার জীবন’ গানের ব্রিজলাইনটুকু নিয়ে ‘বীর’ সিনেমার জন্য নতুন করে গানটি তৈরি করা হয়েছে। গানটি লিখেছেন কবির বকুল। ভারতের সংগীত পরিচালক আকাশ সেনের সংগীতায়োজনে গানটিতে কণ্ঠ দেন ইমরান ও কোনাল।
নকল কথা ও সুরের গান গেয়ে কীভাবে কোনাল জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেল এমন অভিযোগ তুলেছে এই গান ব্যবহৃত সিনেমার প্রযোজক মো. ইকবার নিজেও।
এ সম্পর্কে ইকবাল একটি ভিডিওবার্তায় বলেন, ‘এই গানের কথা নকল, সুরও নকল। গানটির মিউজিক করেছি ইন্ডিয়া থেকে। তাহলে নকল এই গানে কোনাল কীভাবে পুরস্কার পায়? আমার সেন্সে মনে হয় এই গানে কোনাল কখনই পুরস্কার পায় না । কারণ আমি অন্যায়কে কখনও সাপোর্ট করি না। কথা নকল, সুর নকল কোনো গান কখনও পুরস্কার পায় না। মৌলিক গান নতুন গান পুরস্কার পেতে পারে। আমারও একটা প্রশ্ন জাগে-রুনা লায়লা ম্যাডাম যখন গানটি ১৯৮৮ সালে গেয়েছেন তখন কি উনি এই গানটির জন্য পুরস্কার পেয়েছিল? আমার জানা মতে উনি পুরস্কার পাননি। আর যদি উনি পুরস্কারটা পেয়েও থাকেন তাহলে এক গানে কি দুইবার পুরস্কার দেওয়া হবে? তবে আমি জেনেছি ১৯৮৮ সালে রুনা লায়লা পুরস্কার পাননি। তাহলে কি কোনাল রুনা লায়লার চেয়েও বড় শিল্পী? প্রশ্ন আপনাদের কাছে।’
এদিকে কপিরাইট আইন লঙ্ঘন ও নকল গানে কণ্ঠশিল্পী সোমনুর মনির কোনালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বাতিল চেয়ে ইতিমধ্যে হাইকোর্টে রিট আবেদনও করেছেন মো: শামীম নামের এক ব্যক্তি।
এই রিট আবেদনে বিবাদীদের মধ্যে আছেন-মন্ত্রিপরিষদ সচিব, তথ্য সচিব, সংশ্লিষ্ট জুরিবোর্ডের সভাপতি ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন ও চলচ্চিত্র) মো. মিজান-উল আলম এবং সোমনমুর মনির কোনাল।
এ সম্পর্কে আইনজীবী খান জিয়াউর রহমান বলেন, ‘তুমি আমার জীবন, আমি তোমার জীবন গানটি গেয়ে কোনাল জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেতে যাচ্ছেন। এই গানটি রিমেক ও নকল গান। এই গান আগে গেয়েছিলেন দুই কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী রুনা লায়লা ও এন্ড্রু কিশোর। এই গানে রুনা লায়লা ও এন্ড্রু কিশোর জাতীয় পুরস্কার পাননি। তাহলে তাদের গান নকল ও রিমেক করে গেয়ে কোনাল কীভাবে পুরস্কার পান এটাই আমাদের রিটের মুল বিষয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘কপিরাইট আইন লঙ্ঘন ও নকল গানে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার দেয়ায় এই পুরস্কারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এটা আমাদের শুদ্ধ সংস্কৃতির জন্য হুমকিস্বরূপ। তাই মহামান্য হাইকোর্টে কণ্ঠশিল্পী কোনালের পুরস্কার প্রাপ্তির প্রক্রিয়া স্থগিত এবং বাতিল চেয়ে রিট আবেদন করা হয়েছে। আশা করি মহামান্য আদালত এই কণ্ঠশিল্পীর প্রশ্নবিদ্ধ পুরস্কারটি বাতিল করার নির্দেশ দেবেন। কারণ নকল করে গাওয়া গানের-জন্য পেতে যাওয়া এ পুরস্কার বাতিল হলে ভবিষ্যতে আর এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না।’
‘অবুঝ হৃদয়’ সিনেমার ‘তুমি আমার জীবন আমি তোমার জীবন’ গানের ব্রিজলাইনটুকু নিয়ে ‘বীর’ সিনেমার জন্য নতুন করে গানটি তৈরি করা হয়েছে। গানটি লিখেছেন কবির বকুল। ভারতের সংগীত পরিচালক আকাশ সেনের সংগীতায়োজনে গানটিতে কণ্ঠ দেন ইমরান ও কোনাল। তথ্য মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপনে গানটির নাম ‘ভালোবাসার মানুষ তুমি’ লেখা হয়েছে। তবে শাকিব খানের এসকে ফিল্মসের ইউটিউব চ্যানেলে গানটি ‘তুমি আমার জীবন’ নামেই প্রকাশ হয়েছে।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের চলচ্চিত্র শাখার একজন কর্মকর্তা ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘এ বিষয়ে কোর্টে রিট হয়েছে আমাদের জানা নেই। তবে কোর্টের আদেশ পেলে অবশ্যই বিষয়টি বিবেচনা করা হবে এবং ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
উল্লেখ্য, ‘অবুঝ হৃদয়’ সিনেমায় আহম্মেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের লেখা ও সুরে ‘তুমি আমার জীবন’ শিরোনামে গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন রুনা লায়লা ও এন্ড্রু কিশোর।
এএম/এমএমএ/