ব্রয়লার মুরগির কেজিতে ক্রেতা গুণছেন ৬৭ টাকা বেশি, নেপথ্যে সিন্ডিকেট
হাতে গোনা কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কারণে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছেনা ব্রয়লার ও পাকিস্তানি মুরগির বাজার। এসব প্রতিষ্ঠান মুরগির দাম ঠিক করে দেয়। যার ফলে খুচরা ব্যবসায়ীরা পড়েছেন মহাসংকটে। আর সাধারণ ক্রেতার পকেট থেকে প্রতি কেজিতে কমপক্ষে ৬৭ কেটে নিচ্ছে ব্যবসায়ীরা।
গত সপ্তাহে সরকারের জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিকারের পক্ষ থেকে বাজারে অভিযান চালিয়ে ব্রয়লার মুরগির দাম বেশি না নেওয়ার জন্য ব্যবসায়ীদের হুঁশিয়ার করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ৩-৪ দিন যেতে না যেতেই বাজার আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। ২০০ থেকে ২১০ টাকার ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়ে আবারও বিক্রি হচ্ছে ২৩০ থেকে ২৪০ টাকা কেজি।
দাম বাড়ার পেছনে সরাসরি করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়ি করছেন খুচরা বিক্রেতারা। করপোরেট ফার্ম, আড়ৎ ও পাইকারি বিক্রেতাদের সিন্ডিকেটের কারণে মুরগির দাম বাড়ছে। তবে কেউ দায় স্বীকার করছে না। আড়তে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১৭৮ থেকে ১৮২ টাকায়। আর রাজধানীর পাইকারি বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ১৯৬ টাকা কেজি। কিন্তু সেই মুরগি পাশের দোকানেই খুচরা ব্যবসায়ীরা বিক্রি করছেন ২৩০ টাকা কেজি। অথচ পোলট্রি ফার্ম থেকে সেই মুরগি আড়ৎ কিংবা ডিলারের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে প্রতি কেজি ১৬৩ টাকা থেকে ১৬৭ টাকায়। অর্থাৎ ফার্ম থেকে খুচরা বাজার পর্যন্ত ব্রয়লার মুরগির দাম প্রতি কেজিতে কমপক্ষে ৬৭ টাকা বেশি নেওয়া হচ্ছে। যা একেবারেই অস্বাভাবিক।
শুধু ব্রয়লার মুরগিই নয়, পাকিস্তানি মুরগি ফার্মে ২৮৪ টাকা কেজি বিক্রি হলেও পাইকারিতে ২০৫ টাকা, খুচরা পর্যায়ে ৩৫০ টাকা কেজি বিক্রি করছে ব্যবসায়ীরা। টাউনহল, কারওয়ানবাজার, নিউমার্কেটসহ অন্যান্য বাজার ঘুরে ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে মুরগির দামের এই চিত্র পাওয়া গেছে।
রমজান শুরুর আগেই ব্রয়লার মুরগির দাম প্রতি কেজি ২৮০ টাকা ও পাকিস্তানি মুরগি ৩৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে সমালোচনার ঝড় উঠলে সরকার থেকে শুরু করে শীর্ষ ব্যবসায়ীরাও একে অপরকে দোষারোপ করতে থাকে।
এক পর্যায়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বাধ্য হয়ে কঠোর অবস্থানে যায়। তাদের অভিযানে মুরগির দাম কমে আসে। যার সুফল পান সাধারণ ক্রেতারা। গত ৩-৪ দিন প্রতি কেজি ব্রয়লার ২০০ টাকায় ও পাকিস্তানি মুরগি ৩৩০ টাকা কেজি দের কেনেন ক্রেতারা। কিন্তু গতকাল শুক্রবার (৩১ মার্চ) থেকে আবারও অস্থির হয়ে উঠেছে মুরগির বাজার।
শনিবার (১ এপ্রিল) মোহাম্মদপুর স্বপ্নধারা বাজারের আব্দুল খালেক ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ২৩০ টাকা ও পাকিস্তানিটা ৩৫০ টাকা।
টাউনহল মার্কেটের ভিআইপি ব্রয়লার হাউজের বিক্রয়কারী বাবুল বলেন, শুক্রবার থেকে দাম বাড়তির দিকে। আজকে আরও বেশি। ব্রয়লার বিক্রি করা হচ্ছে ২৩০ টাকা, এটা ২০৫ টাকায় কেনা। আর পাকিস্তানি মুরগি ৩৫০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। তা কেনা ৩৩০ টাকা কেজি। পাশের ফরেন চিকেনের জাকির হোসেনও বলেন, ভাই বেশি দামে কেনা। তাই ছোট ব্রয়লার ২০০ টাকা ও বড়গুলো ২২০ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে।
সরকারের চাপাচাপিতে ফার্ম থেকে দাম কমানোর পর দুই দিন আগেও।
মায়ের দোয়া পোল্ট্রি হাউজের মিজান বলেন, ব্রয়লার ২৩০ টাকা ও পাকিস্তানি মুরগি ৩৫০ টাকা এবং দেশিটা ৬৫০ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে। যা দুই দিন আগেও কেজিতে ২০ থেকে ২৫ টাকা কম দামে বিক্রি করেছি।
এ সময় সুমন পোদ্দার নামে এক শিক্ষক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সিন্ডিকেট চক্র আবার তৎপর হয়ে উঠেছে। এজন্য কয়দিন না যেতেই দাম আবার বেড়ে গেছে। এটা খুবই লাগামহীন হয়ে যাচ্ছে।
টাউনহল বাজারে মুরগির পাইকারি বিক্রেতা ব্রয়লার হাউজের মালিক শিবলী মাহমুদ বলেন, রাতে বেলা পাইকারি বিক্রি করি। দিনে খুচরা কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেশি দামে ব্রয়লার ১৯৬ টাকা ও পাকিস্তানি মুরগি ৩৩০ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে।
খাতা দেখিয়ে তিনি আরও বলেন, বগুড়া, গাজিপুর, নরসিংদীর মোকাম থেকে মুরগি কেনা হয়। আজকেও নরসিংদীর শিবপুরের সাইফুল পোল্ট্রি শপ থেকে ব্রয়লার ১৭৮ টাকা ও পাকিস্তানি মুরগি ২৮৪ টাকা কেজি কেনা হয়েছে। যা দুই দিন আগেও ৪ থেকে ৫ টাকা কম দামে কেনা হতো।
হঠাৎ মুরগির দাম বাড়ানোর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, কাজী ফার্মস, সিপি, প্যারাগণসহ বিভিন্ন করপোরেট ফার্মের কারণেই বাড়ছে দাম। কারণ তারাই বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা কমালে বাজারে দাম কমে। বাড়ালে আমাদেরও বেশি দামে কিনে ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করতে হয়।
নিউমার্কেটের বনলতা কাঁচাবাজারের রূপসা চিকেন হাউজের বেলাল হোসেন বলেন, দুই দিন থেকে দাম বাড়তির দিকে। ব্রয়লার ২২০ টাকা ও পাকিস্তানি মুরগি ৩৫০ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে। এই ব্যবসায়ীসহ অন্য বিক্রেতারাও জানান, করপোরেট ফার্মের কারণে বাড়ছে দাম। তারা দাম কমালে কমে, বাড়ালে বাড়ে।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারেও বেড়েছে মুরগির দাম। এই বাজারের নুরজাহান ব্রয়লার হাউজের মো. নবী ও মা সাফিয়া মুরগির আড়তের ইয়াছিন বলেন, গত সপ্তাহে কম দামে বিক্রি করলেও এ সপ্তাহ থেকে বাড়তি দাম। ব্রয়লার ২০০ টাকা ও পাকিস্তানিটা ৩২০ টাকা বিক্রি করা হচ্ছে। যা আগে ১৯০ ও ৩০০ টাকা বিক্রি করেছি।
এদিকে, মুরগির অযৌক্তিক মূল্য বৃদ্ধি পেলে গত ৯ মার্চ পোল্ট্রি মুরগি উৎপাদনকারি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ভোক্তা অধিদপ্তর মতবিনিময় সভা করে। সেখানে জানানো হয়, করপোরেট পর্যায়ে ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন ব্যয় ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা কেজি ও প্রান্তিক খামারি পর্যায়ে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা।
ওই সভায় খুচরা ব্যবসায়ীরা জানিয়েছিলেন, খুচরা পর্যায়ে ব্রয়লার মুরগির দাম যৌক্তিক পর্যায়ে রাখা হবে। তারপরও বাজার লাগামহীন হতে থাকে। বাধ্য হয়ে ভো্ক্তা অধিদপ্তর আবারও ২৩ মার্চ প্রয়োজনীয় তথ্য নিয়ে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যাখা দিতে বলা হয়। অন্যথায় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে চিঠিতে জানানো হয়।
সভায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, মুরগির বাজার করপোরেটের কাছে চলে গেছে। তারা এসএমএসের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। তারা খাদ্য ও মুরগির বাচ্চার দামও নিয়ন্ত্রণ করে।
রমজানের আগের দিন পোল্ট্রি করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে ডাকা হয়। তারা বলে উৎপাদন খরচ ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা। ছোট খামারিদের খরচ হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা। তাই খুচরা পর্যায়ে ১৮৫ থেকে ১৯০ টাকা কেজি বিক্রি করা হবে। তারপর থেকে গত সপ্তাহে মুরগির দাম কমতে শুরু করে।
কিন্তু ৩-৪ দিন না যেতেই শুক্রবার থেকে দাম আবার বেড়েছে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকারের পরিচালক ও উপ-সচিব মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার শনিবার ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, এভাবে দাম বাড়ার কোনো যুক্তি দেখি না। পাইকারি থেকে কেনার পর ব্রয়লার খুচরা পর্যায়ে সর্বোচ্চ ১৯০ টাকা কেজি ও পাকিস্তানি মুরগি ৩২০ টাকা বিক্রি হতে পারে। কেউ বেশি দামে বিক্রি করলে অবশ্যই দেখা হবে। তাদের শান্তির আওতায় আনা হবে।
এনএইচবি/এমএমএ/